কখনো ঝরে যেও না!

 

কখনো ঝরে যেও না!

উস্তাদ তারিক মেহান্না

মু'মিন ব্যক্তি হচ্ছে বৃক্ষের মতো; দমকা হাওয়ার সাথে সর্বদা যুদ্ধে লিপ্ত। এই প্রবল বাতাসের ঝাপটার মাঝে বেঁচে থাকতে হলে সে বৃক্ষটির কিছু গুণ থাকা চাই। যেমন, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে হলে গাছটির বীজ অবশ্যই উর্বর মাটিতে বপন করতে হবে। কুরআনে ঠিক এ কথাটাই বলা আছে:

“মুহাম্মদ আল্লাহর রসূল এবং তাঁর সহচরগণ … তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে তাদের বর্ণনা এরূপ যেমন একটি চারা গাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে, চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে, যেন আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন…” [সূরা আল-ফাতহ, ৪৮: ২৯]

তাওরাতের নিম্নোক্ত বিবরণটির কথা এখানে বলা হয়েছে:

কৃষক তার বীজ বুনতে বের হলো। বপনের সময় কিছু বীজ পথের পাশে পড়ল। সেগুলোর কিছু পায়ের নিচে পিষ্ট হয় আর কিছু পাখিরা খেয়ে ফেলে। কিছু বীজ পড়ল পাথুরে মাটিতে। আর্দ্রতার অভাবে সেগুলো বড় হতে হতেই শুকিয়ে গেলো। কিছু বীজ কাঁটার মাঝে পড়ল। ঐ বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছের সাথে সাথে কাঁটাগুলোও বেড়ে উঠতে থাকে। একসময় কাঁটাগুলোই গাছগুলোকে মেরে ফেলে। বাকি বীজগুলো পড়ল উর্বর মাটিতে। সেগুলো বেড়ে উঠল মাথা উঁচু করে। আর বেড়ে উঠে শতগুণ বেশী শস্য উৎপাদন করল।

… এর তুলনা হলো এই: বীজগুলো হলো সৃষ্টিকর্তার বাণী। কিছু মানুষ সেই বাণী শুনার পর শয়তানের প্ররোচনায় সেগুলো অন্তর থেকে মুছে ফেলে। ফলে এরা ঈমান আনে না। তাই পরিশেষে এরা রক্ষা পাবে না। এদের তুলনা হচ্ছে পথের পাশের সেই অবহেলিত জমি।

কিছু লোক শুনার সময় আগ্রহের সাথে শুনে কিন্তু এদের আগ্রহে গভীরতা নেই। এরা কিছু সময়ের জন্য বিশ্বাস করে কিন্তু প্রলোভন দেখালেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই শ্রেণির লোকের উদাহরণ হলো সেই পাথুরে মাটি যা আর্দ্রতার অভাবে গাছগুলোকে বেড়ে উঠতে দিতে পারে না। কাঁটাযুক্ত জমি হচ্ছে তাদের উপমা যারা সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনেছে কিন্তু পথ চলতে চলতে একসময় ভয় আর দুনিয়ার মোহে আটকে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করতে ব্যর্থ হয়।

কিন্তু কিছু লোক সৎ এবং শুদ্ধ হৃদয় নিয়ে সৃষ্টিকর্তার বাণী শুনে তা আঁকড়ে ধরেছিল এবং ধৈর্যের সাথে পরিশেষে ফল লাভ করেছিল। এদের উদাহরণ হচ্ছে সেই উর্বর মাটি যা বীজকে বুকে নিয়ে মহীরুহের জন্ম দেয়। [লুক ৮: ৫-১৫]

অর্থাৎ, হৃদয়কে এমন উর্বর মাটির সাথে তুলনা করা হয়েছে যেখানে বীজ বপন করা হয়। ইমাম ইবন আল-ক্বাইয়্যিম / আল-ফাওয়াইদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭০) এভাবেই বলেছেন,

“সবার হৃদয়ের স্বাভাবিক অবস্থাই হচ্ছে উর্বর, এতে যা বপন করা হয় তাই সহজে বেড়ে উঠে। যদি ঈমান এবং আল্লাহভীরুতা বা তাক্বওয়ার চারা এতে রোপণ করা হয়, তবে তা এমন সুমিষ্ট ফল দান করবে যা হবে চিরন্তন। আর যদি অজ্ঞতা এবং কামনা-বাসনার চারা রোপণ করা হয় তাহলে তার ফল হবে তিক্ত এবং কটু।”

তাই তুমি যখন তোমার অন্তরকে ঈমানের বীজের জন্য উর্বর করে তুলবে, তখন সেই গাছটি সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠবে এবং মিষ্টি ফল ধারণ করবে। হৃদয়কে উর্বর করার উপায়গুলো সামনে আলোচনা করা হবে।

যখন তোমার হৃদয়ে ঈমানের সুদৃঢ় বৃক্ষ গড়ে উঠবে, তখন একটা দমকা হাওয়া তোমার দিকে ধেয়ে আসবে। কারণ উপরে বর্ণিত আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহ বলছেন শক্ত গাছটি ‘কাফেরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করে’

একজন দৃঢ় মুসলিমের মতো আর কোনো কিছুই এই বাতাসকে এতটা ক্ষেপিয়ে তোলে না। আর এটাই চিরন্তন বাস্তবতা। যখন ফির‘আউন মুসা (আ)এবং তাঁর অনুসারীদের পিছনে মিশরের মরুভূমিতে ধাওয়া করছিল তখন সে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে:

“নিশ্চয়ই এরা (বনী-ইসরাঈলরা) ক্ষুদ্র একটি দল। এবং তারা আমাদের ক্রোধের উদ্রেক করেছে।” [সূরা শুআরা, ২৬: ৫৪-৫৫]

এই দমকা হাওয়া তোমাকে সমূলে উচ্ছেদ করে ফেলে দিতে চাইবে। তুমি হয়তো চারিদিকে তাকিয়ে অন্য কিছু গাছকে সহজেই পড়ে যেতে দেখবে। কেউ হয়তো বাতাসের ধাক্কায় সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে। এরা হলো মুনাফিক্বেরা। এদের দুর্বল মূল সহজেই প্রকাশ হয়ে পড়ে:

“এবং নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে নেওয়া হয়েছে। এর কোনো স্থিতি নেই।” [সূরা ইবরাহিম, ১৪: ২৬]

রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বিশেষভাবে মুনাফিক্বকে এমন গাছের সাথে তুলনা করেছেন যেটা বাতাসের সাথে সাথে নড়ে এবং কখনো বা পড়ে যায়। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস #১৭৯১)।

সুতরাং তারা দলে দলে বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যাক, তুমি তাদের মতো হয়ো না। বরং, তুমি তাদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন কর। আল্লাহকে ধন্যবাদ দাও যে, তিনি তোমাকে তাদের পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন এবং তারপর এগিয়ে যাও। তাদের জন্য ইসলাম ছিল একটা শখ মাত্র, এ সপ্তাহের আকর্ষণ!

যখন বাতাস বুঝতে পারবে যে, তোমাকে এভাবে মাটি থেকে সরাসরি তুলে ফেলা সম্ভব নয়, তখন সে আরো সূক্ষ্ণ পন্থা অবলম্বন করবে: সে চেষ্টা করবে তোমার পাতাগুলো কৌশলে ঝরিয়ে দিতে। কিন্তু সে তোমাকে সবগুলো পাতা একসাথে ঝরাতে বলবে না।

কারণ সেটা তো তার দুরভিসন্ধি প্রকাশ করে দেবে। বরং তখন সেই বাতাস মৃদুভাবে বইবে যাতে করে তোমার একটা পাতা ঝরাতে পারে, তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা – যতক্ষণ না তুমি পাতাহীন বৃক্ষে পরিণত হও। উস্তাদ সাইয়্যিদ কুতুব এটা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:

“… কোনো আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠীর প্রতি শাসকবর্গের আচরণ এমন হয় যে, তারা সবসময় কূটকৌশলের মাধ্যমে সেই আদর্শিক গোষ্ঠীকে তাদের দৃঢ় অবস্থান থেকে শুধু সামান্য বিচ্যুত করতে চায়।

তারা এর মাধ্যমে একটা সমঝোতামূলক সমাধানে আসতে চায়। কিছু জাগতিক পুরস্কারের বিনিময়ে তারা তাদেরকে বোকা বানাতে চেষ্টা করে। এমন অনেকেই রয়েছে যারা ভাবে যে তারা তাদের আদর্শের জন্য লড়ছে কিন্তু বস্তুত তাদেরকে সমঝোতা আর আপসের ছদ্মবেশে তাদের আদর্শ থেকেই বিচ্যুত করে দেওয়া হয়েছে।

কারণ তারা আদর্শকে জলাঞ্জলি দেওয়া এই সমঝোতাগুলোকে বড় করে দেখে না। তাই বিরোধীপক্ষও তাদেরকে প্রকাশ্যভাবে আদর্শ ত্যাগ করতে বলে না। বরং এদিকে সেদিকে হালকা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করে যাতে উভয়পক্ষ মাঝখানে মিলিত হতে পারে।

যে মানুষটি আদর্শের পক্ষে লড়ছে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দিতে বলে, কর্তৃপক্ষের সাথে সামান্য সমঝোতার মাধ্যমে তো তুমি তোমার আদর্শকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু পথের শুরুতে যে বিচ্যুতি খুব সামান্য হয়, পথের শেষে তা-ই বিশাল হয়ে দেখা দেয়।

আদর্শের পতাকাবাহীরা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে আপস করতে রাজি হওয়ার পর আসলে সেখানেই থেমে যেতে পারে না। কারণ এরপর যখনই এক পা পিছিয়ে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে তখনি সেটা ঠেকাতে তার সমঝোতায় আসার ইচ্ছা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই কর্তৃপক্ষ এই আদর্শবাদীদেরকে অতি সন্তর্পণে এবং ক্রমান্বয়ে তাদের আদর্শ থেকে টলাতে থাকে…”

তাই এই ফাঁদে পা দিবে না। বাতাসের মুখে একটা পাতাকেও ঝরতে দেবে না। যেভাবে রসূলুল্লাহ (সা) মুনাফিক্বকে বাতাসের সাথে নুয়ে পড়া গাছের তুলনা দিয়েছেন তেমনি ভাবে মু’মিনকে খেজুর গাছের সাথে তুলনা করেছেন। কারণ খেজুর গাছের পাতা কখনো ঝরে না। (দেখুন আল-লু’লু’ ওয়াল মারজান, হাদিস #১৭৯২)

বাতাস যতই তীব্র হোক না কেন তার সামনে মুসলিম শুধু দাঁড়িয়েই থাকে না, বরং সব পাতা মেলে মাথা উঁচু করে থাকে। বাতাস যত তীব্র হবে তোমার পাতাগুলোকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে। আর এ জন্যই তো তোমার বিরুদ্ধে বাতাসের এত ক্ষোভ !

“তারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল শুধু এ কারণে যে, তারা প্রশংসিত, পরাক্রান্ত আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল” [সূরা বুরুজ, ৮৫: ৮]

কিন্তু এই বাতাস তার ক্ষোভের পেছনে ভিন্ন কারণ দাঁড় করিয়ে এই বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। সে দাবী করবে এই রাগ আসলে তোমার বিরুদ্ধে নয়। এই রাগ তো কেবল উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ কিংবা অন্য কোনো কিছুর বিরুদ্ধে।

কিন্তু সত্য কথাটা হচ্ছে যাদেরকে সে সমূলে তুলে ফেলতে পারে না, যাদেরকে তাদের আদর্শ থেকে এক বিন্দুও টলানো যায় না ঐসব মুসলিমদেরকে সে ভারি অপছন্দ করে। আর যখন গাছটা একটা পাতাও ত্যাগ করতে অস্বীকার করে তখন সেই বাতাস আরো রেগে যায়। আর যখন এই বাতাস রাগতে থাকবে, তখন আল্লাহ তোমাকে পুরস্কৃত করবেন:

“…এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফেরদের মনে ক্রোধের কারণ হয় আর শত্রুদের পক্ষ থেকে তারা যা কিছু প্রাপ্ত হয়- তার প্রত্যেকটির পরিবর্তে তাদের জন্য লিখিত হয় নেক আমল। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের হক নষ্ট করেন না।” [সূরা আত-তওবাহ, ৯: ১২০]

তাই যখন প্রবল আক্রোশে বাতাস বইবে তখন ভয় পেও না। বরং তার চোখে চোখ রাখো আর:

“…বল, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক।” [সূরা আলে ইমরান, ৩: ১১৯]

ঐ পাতাগুলো হচ্ছে আল্লাহর তরফ থেকে তোমার প্রতি আমানত। আল্লাহ তোমাকে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করতে দিয়েছেন। যদি তুমি তার খিয়ানত কর তবে তোমাকে এমন মানুষ দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হবে যারা তাদের আমানত রক্ষা করবে।

“হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে স্বীয় দ্বীন থেকে ফিরে যাবে, অচিরে আল্লাহ এমন সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালোবাসবে।

তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভীত হবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। …” [সূরা আল-মা’ইদাহ, ৫: ৫৪]

এই আয়াতটি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে গাছ এবং পাতাগুলোর বর্ণনা দেয়। এটাকে বীজ এবং পাতায় বিশ্লেষণ করা যাক।

সম্পূর্ণ গাছটি হচ্ছে দ্বীন।

তোমার অন্তরে আল্লাহর জন্য ভালোবাসার বীজ থেকে এই গাছটি অংকুরিত হবে। আত-তুহফাহ আল ইরাক্বিয়াহ নামে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহর একটি সুন্দর প্রবন্ধ রয়েছে। মাজমু আল ফাতওয়ার দশম খণ্ডের শুরুতে এটি পাওয়া যাবে। সেখানে তিনি এই আয়াতে উল্লেখিত ভালোবাসার কথা ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে,

“আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের জন্য ভালোবাসা হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি এবং ঈমানের সর্বোচ্চ মূলনীতি। কার্যত এটিই দ্বীনের সকল আমলের মূল ভিত্তি… মুসা এবং ঈসা (আ)এর বর্ণিত ভাষ্য অনুযায়ী, আমাদের পূর্ববর্তী দুটি জাতি, ইহুদি এবং খৃস্টানদের প্রতি রেখে যাওয়া সর্বোত্তম উপদেশ হচ্ছে হৃদয়, মন এবং সদিচ্ছা দ্বারা সর্বান্তকরণে আল্লাহকে ভালোবাসা। এটাই ইব্রাহীমের (আ)দ্বীনের আক্বীদার সারকথা যা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং ক্বুরআনের আইনের নির্যাস।”

আল্লাহর জন্য ভালোবাসাই হচ্ছে সেই বীজ যা থেকে প্রতিটি কাজ এবং বিশ্বাস – প্রতিটি পাতা এবং ফল- অংকুরিত হয় আর এজন্যই এই ভালোবাসাটাই এ আয়াতে সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।

তারপর আমরা লাভ করব সেই বীজের প্রথম ফল, ওয়ালা’ এবং বারা’: ‘মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে’। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ / এ বিষয়ে বর্ণনা করেন,

“মানুষ যাকে ভালোবাসে তার ভালোবাসার মানুষকেও ভালোবাসে, সে যা ঘৃণা করে তাও ঘৃণা করে, তার সহযোগীদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, তার শত্রুদের প্রতি শত্রুভাব পোষণ করে… তাই এই বিষয়ে তারা উভয়েই এক।”

সহজ ভাষায় বললে, বাতাসের প্রথম কাজ হচ্ছে তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দেওয়া যাতে করে তোমার মনে শত্রু আর বন্ধুর মাঝে বিভাজন রেখাটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। একবার যখন তুমি তোমার শত্রুকে বন্ধু ভাববে, তোমার শত্রুর কাজ তখনি সম্পন্ন হয়ে যাবে। তাই কখনো এই পাতাটি ঝরে যেতে দিবে না। কখনো না!

এর পরের পাতাটি হচ্ছে জিহাদ: “…তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে…” স্পষ্টতই এই পাতাটিকে বাতাস অন্যগুলোর চেয়ে বেশী ঘৃণা করে। কেন তা বোঝার জন্য এইডস এর কথা ভাবো। এটা শরীরকে মেরে ফেলার জন্য কী করে? এইডস কিন্তু সরাসরি শরীরকে আক্রমণ করে না বরং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অর্থাৎ শরীরের ‘প্রতিরক্ষা বাহিনী’কে আক্রমণ করে যাতে করে অন্যান্য রোগ জীবাণু কোনোরকম বাধা ছাড়াই আক্রমণ করতে পারে। এই শরীরটা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর মতো।

জিহাদ হচ্ছে এর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সে আক্রমণকারীদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে। আর সেই বাতাস/সরকার হচ্ছে এইডসের মতো যা প্রতিরোধের এই স্পৃহাটাকে মেরে ফেলার জন্য কাজ করে যাতে করে মুসলিম উম্মাহকে আক্রমণ এবং দখল করে নেওয়া সহজ হয়ে যায়।

এই কারণেই সাইয়্যিদ কুতুব, আব্দুল্লাহ আযযাম, আয-যারক্বাওয়ী, শাইখ ওসামা প্রমুখদের মতো লোকদেরকে আজ দানবরূপে চিত্রিত করা হয়। কারণ এরা প্রতিরোধের সেই চেতনাকে ধারণ করেন। আর তাই তোমার এই পাতাটি ঝরিয়ে দিতেই বাতাস সবচে জোরে বইবে। এই ফাঁদে পা দিও না। মনে রেখো: এইডস!

পরিশেষে সুদৃঢ় বৃক্ষ সেটাই যা “কোনো নিন্দাকারীর নিন্দায় ভীত হবে না”

বস্তুত বৃক্ষটি তিরস্কার বা নিন্দায় প্রভাবিত হবে। কিন্তু সেভাবে নয়, যেমনটি আশা করা হয়েছিল! সেটা কেমন হবে ? যখন বাতাস তোমার পাতাগুলো ঝরিয়ে দিতে চায়- যখন ‘ওয়ালা এবং বারা’ আর জিহাদের ধারণাকে আঁকড়ে ধরে রাখার কারণে সে তোমাকে আক্রমণ আর তিরস্কার করে তখন ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহর ভাষায় তোমার প্রতিক্রিয়া হবে এমন:

“যার হৃদয় আল্লাহর জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সে অন্য কারো সমালোচনা বা তিরস্কারে দমে যায় না বরং এগুলো তাকে আরো শক্তভাবে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে প্রেরণা যোগায়…”

সবশেষে এই আয়াত আমাদেরকে সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেয় যে কুরআনের এই শিক্ষাগুলোর প্রতি সৎ থাকতে পারা হলো, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ-তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন’। বাতাসের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারাটা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর একটা অনুগ্রহ। একটা গাছকে সোজা হয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে বা ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আল্লাহই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী:

“তোমরা যে বীজ বপন কর, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তাকে উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্নকারী? আমি ইচ্ছা করলে তাকে খড়কুটা করে দিতে পারি, অতঃপর হয়ে যাবে তোমরা বিস্ময়াবিষ্ট।” [সূরা ওয়াক্বিয়াহ, ৫৬: ৬৩-৬৫]

শেষ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রসূলুল্লাহ (সা)আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে শেষ যামানায় কারো বদলে যাওয়াটা খুব সহজ হয়ে পড়বে। মানুষ চাপে পড়ে এবং নিজেদের দুর্বলতার কারণে খুব দ্রুত সত্যকে ত্যাগ করবে। তিনি (সা)বলেন:

“পুনরুত্থান দিবসের আগে, রাতের অন্ধকারের মতো ফিতনা আসবে যার মাঝে একজন মানুষ মু’মিন হয়ে ঘুম থেকে উঠবে আর কাফির হয়ে ঘুমাতে যাবে, আবার মু’মিন হয়ে ঘুমাতে যাবে আর কাফির হিসাবে জেগে উঠবে।”

এই ধরনের ঘটনাগুলো হচ্ছে কিছু অজানা বা গায়েবী ঘটনার ফল যা আমরা মানুষেরা হয়তো ঠিক উপলব্ধি করতে পারব না। তবে, কুরআন এবং সুন্নাহতে এমন কিছু ব্যবহারিক উপায় বলে দেওয়া আছে যার সাহায্যে আমরা মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঠিক পক্ষে থাকতে পারি।

এখানে আমরা শুধু দুটি উপায় আলোচনা করব এবং দুটিই একটি মজবুত বৃক্ষের দৃঢ়তার সর্বপ্রথম শর্তটির উপর আলোকপাত করে: উর্বর জমি- একটি সুস্থ হৃদয়।

রসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় যখন কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর প্রতি নাযিলকৃত সূরাসমূহের মূল বিষয় ছিল পূর্ববর্তী নবীদের কাহিনি। ইসলামের জন্য কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন যে তিনিই প্রথম নন, বরং যুগে যুগে এমন আরো অনেকেই ছিলেন, এটা বোঝানোই ছিল এর উদ্দেশ্য।

একই সাথে আগের নবীরা কীভাবে এসব পরীক্ষার মোকাবিলা করেছিলেন সে শিক্ষাও তাঁকে এর মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছিল। মক্কার বিপদের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন দিনগুলোতে এই ইতিহাসের গল্পগুলো রসূলুল্লাহ (সা)এবং সাহাবিদের মনোবল দৃঢ় করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। এই কথাটিই নিমোক্ত আয়াতে প্রতিফলিত হয়,

“আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যার দ্বারা তোমার অন্তরকে মজবুত করছি। আর এভাবে তোমার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে।” [সূরা হুদ, ১১: ১২০]

একইভাবে প্রথম দিককার মুসলিমদের সেইসব কঠোর পরীক্ষার দিনগুলোর পাশাপাশি ইতিহাস, বিশেষভাবে সেই সকল মুসলিমদের ইতিহাস অধ্যয়ন করাটা উপকারী হতে পারে যারা তাদের সময়ে কোনো না কোনো প্রকারের সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অনেক সময় কোনো একটা পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় বুঝে উঠতে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ফিক্বহের বই ঘাঁটি যেখানে শুধুমাত্র সৎকর্মশীলদের জীবনী পড়েই তাদের ব্যক্তিত্বকে আত্মস্থ করার মাধ্যমে আমাদের করণীয় সম্বন্ধে আরো ভাল দিকনির্দেশনা পেতে পারি। ‘সাফাহাত মিন সবর আল উলামা’(আলেমদের সবরের পাতা থেকে) নামক অসাধারণ বইটিতে লেখক বলেন:

“নিজের মধ্যে সৎগুণের বিকাশ ঘটাতে এবং মহৎ উদ্দেশ্যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা তৈরী করার একটি ভালো উপায় হচ্ছে সেই সকল আলেমদের জীবনী পড়া যারা তাঁদের অর্জিত ‘ইলমের উপর আ’মল করেছেন।

মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য অধ্যবসায়ের সাথে ত্যাগ স্বীকার করে যাওয়া আলেমদের পদাঙ্ক অনুসরণের ক্ষেত্রে তাদের জীবনী পড়াটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বলা হয়ে থাকে এই কাহিনিগুলো হচ্ছে আল্লাহ্‌র সেই সকল সৈন্য যার মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয়পাত্রদের অন্তরকে সুস্থির রাখেন।

ইমাম আবু হানিফা বলেন,

“আলেমদের জীবনী এবং তাঁদের গুণাবলি অধ্যয়ন আমার কাছে ‘ইলমের চেয়ে বেশী প্রিয় কারণ এগুলো তাঁদের চরিত্র বর্ণনা করে।”

তাই সৎকর্মশীলদের জীবনী অধ্যয়ন, তাঁদের ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্রকে আপন করে নেয়া অন্তরকে শক্তিশালী এবং জীবন্ত করার একটি ভালো উপায়। এটি ঈমান এবং ‘ইলমের বীজ বপনের জন্য অন্তরকে উর্বর করে তোলে। তাহলে কোথা থেকে শুরু করা উচিত?

শাইখ ইবনে আল জাওযী সাইদ আল খাতির গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় বলেন,

রসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর সাহাবিদের জীবনী থেকেই সবচেয়ে বেশি উপকারী জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

অন্তরকে দৃঢ় করার দ্বিতীয় উপায়টি আরো সহজ: শুধু তোমার রব্ব এর কাছে চাও! উম্মে সালামাহ (রা) কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রসূলুল্লাহ (সা)কোন দুআটি সবচেয়ে বেশি করতেন। উত্তরে তিনি বলেন:

“ওনার সবচেয়ে বেশি করা দু‘আটি ছিল: ও অন্তর সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী, আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির করে দাও। (ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলুব, সাব্বিত ক্বলবি ‘আলা দ্বীনিক)”

এই দুআটি সারাদিন সবসময় অভ্যাস করা উচিত। কাজে যাওয়ার সময় কিংবা স্কুলের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় যখনই সুযোগ পাওয়া যায় তখনই এই সহজ দুআটি পুনরাবৃত্তি করার অভ্যাস করা উচিত।

গুপ্তধনের মতো এই দুআটিকে আঁকড়ে রাখা উচিত এবং সর্বদা এটিকে ঠোঁটের ডগায় রেখে অন্তরকে ইসলামের সাথে সংযুক্ত করে রাখা উচিত। এটা খুবই সহজ হওয়া সত্ত্বেও এটা যাদের খুব প্রয়োজন তাদের অনেকেই এটিকে অবহেলা করে।

তাই হৃদয়কে স্থির এবং সুস্থ রাখার মাধ্যমে, অন্তরের জমিকে উর্বর রাখার মাধ্যমে তোমার শিকড়কে সুদৃঢ় করো। আর মজবুত শিকড়বিশিষ্ট গাছগুলোর শাখা-প্রশাখাই একদিন আকাশ ছোঁয়:

“পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত।” [সূরা ইবরাহিম, ১৪: ২৪]

আর যখন তোমার শাখা-প্রশাখা আকাশ ছোঁবে, তখন কেউ তোমার পাতা পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারবে না। তারা তোমাকে বন্দী করতে পারে, তোমাকে হত্যা করতে পারে কিন্তু তারা কখনো এ কথা বলতে পারবে না যে, তারা তোমার পাতা ঝরাতে পেরেছিল…!

 

তারিক মেহান্না

বুধবার, ৪ সফর ১৪৩৩/ ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১

প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি

আইসোলেশন ইউনিট- সেল#১০৭

0 মন্তব্যসমূহ