অসীম মানসিকতার মৌলিক দিকসমূহ / উপাদানসমূহ
=====================================================
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم
إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه . أمابعد
মাকসাদ: অসীম দ্বন্দ্বগুলোর কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে, যা সসীম দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যের চেয়ে ভিন্ন। যেমন - এখানে প্রচলিত জয়-পরাজয় নেই, বরং টিকে থাকতে পারাই বিজয় এবং ছিটকে পড়াই পরাজয়। অসীম দ্বন্দ্বকে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনে বাঁধা যায়না, এই দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ কখনো শেষ হয়ে যায়না।
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অসীম
দ্বন্দ্বে টিকে থাকতে হলে আপনাকে অবশ্যই অসীম মানসিকতার অধিকারী হতে হবে।
আর অসীম মানসিকতার সবচেয়ে মৌলিক দুটি দিক হলো
- কখনো থেমে না গিয়ে সর্বদা লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
- ক্রমাগত মানোন্নয়ন করে যাওয়া।
এই বিষয়গুলো ভালো করে বুঝা এবং এসব ক্ষেত্রে সসীম মানসিকতার সাথে অসীম মানসিকতার পার্থক্যগুলো অনুধাবন করতে পারাই এই সবকের মাকসাদ।
একটু বিস্তারিতভাবে অসীম মানসিকতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
অসীম মানসিকতার প্রধান ২ টি দিক হলো-
১। অসীম মানসিকতা বলতে বোঝায় লড়াই চালিয়ে যাওয়া, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকার মানসিকতা। এখানে জয়-পরাজয় মূল কথা নয় বা নির্দিষ্ট সময় পর আমরা বিজয়ী হব- এটিও মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত লড়াই জারি রাখা।
বিজয় যদিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অসীম দ্বন্দ্বগুলোর ক্ষেত্রে বিজয় একটি মাকসাদ, কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, লড়াই অব্যাহত রাখা। পরাজয় যদিও বেদনাদায়ক, কিন্তু কোনো একটি অসীম যুদ্ধে পরাজয় মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং এরচেয়েও বড় বিপর্যয় হলো লড়াই থেকে সরে যাওয়া।
যতক্ষণ আমরা আছি ব্যক্তিগতভাবে এবং
যতক্ষণ পর্যন্ত উম্মাহ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত উম্মাহ সার্বিকভাবে যুদ্ধ
চালিয়ে যাবে। জয়-পরাজয় মূখ্য নয়। সমস্ত কাফিরদেরকে একেবারে নির্মূল এবং
অস্তিত্বহীন করে ফেলতে পারাটা মূখ্য নয় (যেটি আসলে সম্ভবও নয়); মূখ্য হচ্ছে
লড়াই জারি রাখা। ইনফিনিট মাইন্ডসেট বা অসীম মানসিকতা বলতে আমরা এটিই
বোঝাতে চাচ্ছি।
শাইখ আনওয়ার আল-আওলাকি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
Its not about winning the race [coming 1st or 2nd] its all about finishing the race [be on track]
"এই লড়াইয়ে জেতা অর্থাৎ ১ম বা ২য় হওয়ার চিন্তা নয় বরং ট্র্যাকে (সঠিক পথে) থেকে লড়াই শেষ করাই হচ্ছে মূল বিষয়।"
২। ক্রমাগতভাবে মানোন্নয়ন করে যাওয়া। অসীম লড়াই যেমন চালিয়ে যেতে হবে, ঠিক তেমনি লড়াই এর ময়দানে টিকে থাকার জন্য ক্রমাগত মানোন্নয়ন করতে হবে।
লড়াই জারি রাখা ও ধারাবাহিক মানোন্নয়ন - এই দুয়ের সমন্বয়েই পরিপূর্ণ হবে ইনফিনিট মাইন্ডসেট বা অসীম মানসিকতা।
অসীম দ্বন্দ্বে যেহেতু অনেক কিছুই অজানা ও অদৃশ্যমান, তাই এখানে সফলতা অর্জন অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু টিকে থাকার মানসিকতা নিয়ে লেগে থাকলে শত্রুপক্ষই এক সময় ছিটকে পড়বে ময়দান থেকে। শেষ পর্যন্ত এই টিকে থাকাটাই হবে সাফল্য। অন্যদিকে এই দ্বন্দ্বে সফলতার একটি সুত্র বলা যায়, "নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে নেয়া"। নিজের কাটানো বিগত দিনের চাইতে আজকের দিনটাকে আরও বেশি উত্তম করা, গত বছরের চাইতে নতুন বছরকে আরও উত্তম করা।
একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় - আমরা অনেকেই ভাবি,
অসীম মানসিকতার ব্যাপারগুলো আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু বাহ্যিকভাবে
আমাদের কাজে তা প্রকাশিত হয় না। অন্তরে, চিন্তাজগতে এবং বাহ্যিক আমলে অসীম
মানসিকতার ভিত্তিতে কাজ করা সম্ভব হলেই দাবী করা যায় যে, আমরা অসীম
মানসিকতা আত্মস্থ করতে পেরেছি।
চলুন, এবারে অসীম মানসিকতা ও সসীম মানসিকতার মাঝে কিছু তুলনা দেখা যাক। কিছু উদাহরণ দিলে দুই মানসিকতার পার্থক্য সুস্পষ্ট হবে ইনশা আল্লাহ।
সসীম ও অসীম মানসিকতার বিষয়টি শুধু
ইমান বা জিহাদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের চারপাশের
সবকিছুতেই এই দুইধরণের মানসিকতা বিদ্যমান রয়েছে।
আমরা পূর্বেও আলোচনা করেছি ইনফিনিট
মাইন্ড সেটের জয় পরাজয় গতানুগতিক জয় পরাজয়ের মতো নয়। এখানে জয় হচ্ছে, শেষ
পর্যন্ত যুদ্ধে টিকে থাকা। যে যুদ্ধ থেকে ছিটকে গেছে, সে পরাজিত হয়েছে।
কিন্তু প্রতিপক্ষ শেষ হয়ে যায়নি! কারণ, অসীম দ্বন্দ্ব কখনো শেষ হওয়ার নয়।
যে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, সে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে,
পরাজিত হয়েছে বলতে এই যুদ্ধ থেকে 'প্রতিপক্ষ' চিরতরে বিদায় নিয়েছে বা তার
আর কোনো অস্তিত্বই নেই বা সেই দলটি একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে,
লড়াইয়ে যে টিকে থাকছে তার প্রতিপক্ষ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তার নতুন প্রতিপক্ষ
আসবে।
এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনে
করি অ্যামেরিকাকে পরাজিত করলেই আমাদের কাজ শেষ। কিন্তু কাজ আসলে শেষ হবে
না। অ্যামেরিকাকে হয়ত আমরা পরাজিত করে ফেলতে পারব। এরপর বিশ্বমঞ্চে আমরাও
সমীহ জাগানিয়া এক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হব। কিন্তু তখন দেখা যাবে পৃথিবীর
অন্য কোনো স্থানে অন্য পরাশক্তির উত্থান হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বমঞ্চে যেমন
চীন এবং রাশিয়ার প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদের পতন হলে হয়ত দেখা
যাবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই বিষয়টি হচ্ছে ইনফিনিট মাইন্ড
সেট বা অসীম দ্বন্দ্ব এর মূল কথা। দ্বন্দ্বের বর্তমান প্রতিপক্ষ ছিটকে পড়লে
নতুন প্রতিপক্ষ আসবে।
অসীম মানসিকতার এই দ্বন্দ্বে নব্বই এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভুল করেছিল অ্যামেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভের পর তারা ভেবেছিল পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিক বনে গিয়েছে অ্যামেরিকা। সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াতে পারবে। তার আর কোনো প্রতিপক্ষ আসবে না।
কিন্তু অ্যামেরিকা ভুল করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভব হয়, তা বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। অ্যামেরিকাকে টক্কর দেবার জন্য চীন, রাশিয়া ইত্যাদি বেশ কয়েকটি পরাশক্তির উত্থান হয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরাও বিশ্বমঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি। ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়েছে, ময়দানের দ্বন্দ্বে নতুন মুখ এসেছে। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। যুদ্ধ জারি আছে।
অনেকে এরকম ভাবেন, আমি না পারলেও চোখের দৃষ্টিতে থাকা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমার পরের প্রজন্ম পৌঁছাবে। যেমন, ইসরায়েল-আমেরিকার পতন, হাসিনা-বাশার-মোদীকে শেষ করা ইত্যাদি। এটিও একধরণের সসীম মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। চোখের দৃষ্টিতে থাকা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আসলে লক্ষ্য না, লক্ষ্য হলো অসীম লক্ষ্য। কুফর আর শিরকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটাই লক্ষ্য। আমাদের এই পুরো দাওরাটি মূলতঃ এই বিষয়টি ফোকাস করেই তৈরি করা হয়েছে। অসীম মানসিকতার এই স্বতন্ত্রতা খেয়াল করা, বুঝা ও উপলব্ধি করা এই দাওরাহর জন্য বিশেষ, একান্তভাবে জরুরি। তবেই আপনি দাওরাহর সূক্ষ্ম পয়েন্টগুলো ধরতে পারবেন, ইনশাল্লাহ।
অন্যদিকে ফাইনাইট মাইন্ডসেট বা সসীম
দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। সব যুদ্ধই
যে ইনফিনিট বা অসীম ব্যাপারটি এমন নয়। সসীম দ্বন্দ্ব বা ফাইনাইট যুদ্ধও
আমাদের মাঝে বিদ্যমান। অসীম যুদ্ধের মাঝেই অনেক গুলো সসীম যুদ্ধ থাকতে
পারে। There can be many battles in a war - অর্থাৎ একটা war-এর মধ্যে অনেকগুলো battle থাকতে পারে - অর্থাৎ, একটা মহাযুদ্ধের মধ্যে অনেকগুলো যুদ্ধ থাকতে পারে। যেমন ধরুন, কাফিরদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
এটি একটি অসীম মানসিকতার যুদ্ধ। আমাদের মূল যুদ্ধ - war । এখন এই অসীম মানসিকতার যুদ্ধেরই একটি সসীম অংশ হলো আফগানিস্তানের মাটিতে অ্যামেরিকা ও ন্যাটোর আগ্রাসন। এই আগ্রাসন অ্যামেরিকা ও ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের মাঝে সম্পাদিত দোহা চুক্তির মাধ্যমে সাময়িকভাবে শেষ হয়ে গেছে। এটা সসীম যুদ্ধ - battle । কিন্তু তার মানে এই নয় যে, মুসলিমদের সাথে অ্যামেরিকার যুদ্ধ চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছে।
দোহা চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তানে অ্যামেরিকার এই নির্দিষ্ট আগ্রাসন বন্ধ হলেও মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। যুদ্ধের ময়দান, ধরণ ইত্যাদি বদলে গেলেও যুদ্ধ চলমান। এই ক্ষেত্রে অ্যামেরিকানদের শব্দচয়নও অনেক চতুর। তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে নামকরণ করেছে "War on Terror" - সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধ। তারা war (মহাযুদ্ধ) শব্দটি নির্বাচন করেছে, battle (সাধারণ যুদ্ধ) ব্যবহার করেনি। এর মাধ্যমে মানুষের অবচেতন মনে এই দ্বন্দ্বের অসীমত্বকে তারা চাষ করতে চাচ্ছে।
খুব সহজ একটি উদাহরণ দেখা যাক।
আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নেই। তাকমীল, অনার্স, মাস্টার্স
ইত্যাদি। এই সুনির্দিষ্ট ডিগ্রি অর্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের
অধীনে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়। এটা হলো সসীম বিষয়। ফাইনাইট
বা সসীম মানসিকতার কর্মযজ্ঞ। কিন্তু জ্ঞান অর্জন শুধু এই নির্দিষ্ট
ডিগ্রীগুলো অর্জনের জন্য, যে সুনির্দিষ্ট সিলেবাসে অধ্যয়ন করতে হয় তার
মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
জ্ঞান অর্জনের মূল কথা হচ্ছে- শেষ পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন, আমৃত্যু জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। একটি নির্দিষ্ট সিলেবাসের অধীনে কিছু নির্দিষ্ট গ্রন্থ অধ্যয়ন করলেই চূড়ান্ত জ্ঞান অর্জিত হবে, বিষয়টি এমন নয়। ক্রমাগতভাবে জ্ঞান অর্জন ও মানোন্নয়ন চালিয়ে যেতে হয়। সব সময় নিজের মানোন্নয়নের ফিকির করতে হবে।
কোন কোন বিষয়ে আমার জ্ঞান অর্জন বাকি, যে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার জ্ঞান আছে তা কিভাবে আরও বাড়াতে পারি...। সংখ্যার যেমন শেষ নেই, ইলম অর্জনেরও তেমন শেষ নেই। কোনো বিষয়ে আমাদের অধ্যয়ন যতো বাড়বে আমরা ততোই উপলবদ্ধি করতে পারব সে বিষয় সম্পর্কে আমাদের ইলম কতোটুকু সীমিত। এই উপলব্ধি, আমৃত্যু জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা, ক্রমাগতভাবে মানোন্নয়ন করে যাওয়া এই বিষয়গুলোই হলো অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অসীম মানসিকতার উদাহরণ।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিলাম, আর সব জেনে ফেললাম বা শিক্ষিত হয়ে গেলাম, এমন চিন্তাধারা হলো সসীম মানসিকতার উদাহরণ।
অসীম মানসিকতার অংশ হিসেবে, অসীম মানসিকতার অভ্যন্তরে সসীম মানসিকতা থাকা দোষের কিছু না। যেমন- স্নাতক করার জন্য আমি নির্দিষ্ট সিলেবাসের অধীনে পড়াশোনা করলাম, এটি সসীম মানসিকতা। কিন্তু এর পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনের বা মানোয়ন্নের অব্যাহত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ক্রমাগত অধ্যয়ন চালিয়ে গেলাম, এটি অসীম মানসিকতা। এখানে মূল মাকসাদ জ্ঞান অর্জন, স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা জ্ঞান অর্জনের একটি অংশমাত্র। কিন্তু সসীম মানসিকতাকেই মূল মাকসাদ বানিয়ে ফেললে সমস্যার উদ্ভব হয়।
যেমন: স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করাকেই অধ্যয়নের মূল মাকসাদ বানিয়ে ফেলা। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি সামগ্রিকভাবে জ্ঞান অর্জন বা মানোন্নয়ন না করে সে শুধু মুখস্থ করে পাশ করতে চাইবে, বুঝতে চাইবে না। আবার এমনভাবে অধ্যয়ন করবে, যেনো পরীক্ষার খাতায় লিখে আসা পর্যন্ত তা স্মৃতিশক্তিতে থাকে।
এই সসীম মানসিকতার ব্যক্তি হয়ত
পরীক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করবে। অন্যদিকে অসীম মানসিকতা নিয়ে অধ্যয়ন করা
ব্যক্তির রেজাল্ট তার মতো ভালো হবে না। কিন্তু এখানে প্রকৃত বিজয়ী আসলে কে?
জ্ঞান অর্জনের মূল মাকসাদ কে অর্জন করতে পেরেছে? প্রকৃতপক্ষে সে-ই মূল
মাকসাদ অর্জন করতে পেরেছে, যে অসীম মানসিকতা নিয়ে অধ্যয়ন করেছে। সে শুধু
পরীক্ষায় পাশের জন্য অধ্যয়ন করেনি। বরং জ্ঞানকে আত্মস্থ করার জন্য অধ্যয়ন
করেছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ব্যক্তিই সফল হবেন। টিকে থাকবেন জ্ঞানের ময়দানে।
বস্তুতঃ শেষ পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনে কেউ
বিজয়ী হয়না। কোনো ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে দাবী করতেই পারে,
‘আলহামদুলিল্লাহ্ আমি জ্ঞান অর্জনে বিজয়ী হয়ে গেছি! উসুল বা ফিকহের
জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমি বিজয়ী হয়ে গেছি! হাদিসের ক্ষেত্রে আমি একজন বিজয়ী
মাশাআল্লাহ!’ কিন্তু এমন দাবী সঠিক বা শোভন নয়। জ্ঞান অর্জনের কোনো
সীমারেখা নেই। এটি অসীম। তাই আপনি বলতে পারবেন না-আমি এতোটুকু পড়েছি, এখন
আমার পড়াশোনা শেষ। কিন্তু স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে আপনি বলতে
পারবেন- আমি এই এই কোর্সগুলো শেষ করেছি, আমার স্নাতক শেষ হয়েছে। কারণ
ডিগ্রি অর্জনের সিলেবাস/পড়াশোনা সসীম।
আমাদের যুদ্ধের ক্ষেত্রেও বলতে পারব
না- এই নির্দিষ্ট কাজগুলো করলে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। আমরা এতোটুকু বলতে
পারব যে, এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আজকের প্রতিপক্ষ পরাজিত হলে আগামীকাল
অন্য এক প্রতিপক্ষ আসবে। এখানে জয় পরাজয় যেমন মূল নয়, তেমনি সুনির্দিষ্ট
নিয়ম কানুন নেই যেগুলো অনুসরণ করলে যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে। প্রতি
মুহূর্তে এখানে নিয়ম কানুন পরিবর্তিত হচ্ছে।
দেখুন, যারা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে চায় তারা কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অনুসরণ করে। কিন্তু আমাদের এই যুদ্ধে অ্যামেরিকা কোনো নিয়ম নীতি অনুসরণ করে না। আপনি হাজার বার বললেও তারা মানবে না। সাধারণ মানুষকে অ্যামেরিকার দ্বিচারিতা বোঝানোর জন্য আমরা এই বিষয়টি সামনে আনি।
কিন্তু আমরাও আসলে আশা করি না যে, অ্যামেরিকা কোনো নিয়ম মানবে। কারণ এটি হলো ইনফিনিট বা অসীম যুদ্ধ। ইনফিনিট যুদ্ধ মানেই এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। প্রত্যেক পক্ষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজস্ব নিয়ম কানুনে যুদ্ধ করবে। এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট মঞ্জিল নেই, যে মঞ্জিলে পৌঁছালে আপনাকে চূড়ান্ত বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হবে, যার পরে আর লড়াই থাকবেনা।
আমরা বলতে পারব না যে, আগামী পাঁচ বছর যদি আমরা দৈনিক আঠারো ঘণ্টা কাজ করি, তাহলেই ইনশাআল্লাহ অ্যামেরিকা পরাজিত হয়ে যাবে বা এই উম্মাহর এক কোটি যুবক দৈনিক আঠারো ঘণ্টা করে কাজ করে তাহলে অ্যামেরিকা শেষ হয়ে যাবে। আমরা ঠিক এভাবে ঘন্টা হিসেবে চিন্তা করিনা। কিন্তু আমাদের চিন্তার গতিধারা বা নির্যাস এই চিন্তার অনুরূপ যা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।
এ পর্যন্ত আমরা যা আলোচনা করলাম তার সারাংশ হলো-
১। অসীম দ্বন্দ্বে জয় পরাজয় মূল বিষয় না। মূল লক্ষ্য হলো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।
২। অসীম দ্বন্দ্বকে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতির মাঝে আবদ্ধ করা যায় না।
৩। অসীম দ্বন্দ্বে শত্রু কখনো নির্মূল হয়ে যায় না। এক প্রতিপক্ষ পরাজিত হলেও অন্য প্রতিপক্ষ আসে।
৪।
অসীম দ্বন্দ্বে একই সময়ে একাধিক শত্রুর সাথে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে
হতে পারে। কিন্তু সসীম দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষ সুনির্দিষ্ট থাকে।
উপসংহার: অসীম মানসিকতার ক্ষেত্র শুধু সামরিক যুদ্ধের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অসীম দ্বন্দ্বের গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক ক্ষেত্র আছে। আদর্শিক যুদ্ধ, বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ, সভ্যতার সংঘাত, অর্থনীতি, রাজনীতি, ব্যবসা - এসবকিছুই অসীম দ্বন্দ্বের একেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
আমরা নিজেরা যদি আমৃত্যু এই অসীম দ্বন্দ্বগুলোতে তাওহিদের পক্ষে অটল, অবিচল ও সক্রিয় থাকতে চাই, আমরা যদি উম্মাহকে সমগ্র বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যেতে চাই তাহলে অসীম মানসিকতার মৌলিক সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ আত্নস্থ করে,অসীম দ্বন্দ্বের গুরুত্বপূর্ণ সকল ফ্রন্টগুলোতে সে মানসিকতা অনুযায়ী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, সসীম মানসিকতার বেড়াজালে আটকে যাওয়া থেকে সযত্নে বেঁচে থাকতে হবে এবং ক্রমাগত মানোন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।
ওয়াল্লাহু তায়ালা আ'লাম।
0 মন্তব্যসমূহ