ইসলাম অনুসরন মানেই নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপন নয়
========================================
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِِ
إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه . أمابعد
মাকসাদঃ অনেকে
এমনভাবে দাওয়াহ প্রচার করে যে ইসলামে আসা মানে জীবনে আর কোন সমস্যাই হবে
না, অতঃপর দ্বীন পালন শুরু করার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন পরীক্ষা আসে তখন
অনেক ভাই ঝরে পড়েন। অথচ কুরআনে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার কথা বলেছেন।
যখন পরীক্ষা আসে, তখনই মানুষের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায়। তাই বিপদ-আপদ ও
পরীক্ষা আসলে আমরা যেন ভেঙ্গে না পড়ে অটল-অবিচল থাকি। এসকল বিষয় পরিষ্কার
করার জন্য আমাদের এই আলোচনা।
দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার সময় বা দ্বীনকে মানুষের সামনে তুলে ধরার সময় অনেক দাঈ একটা ভুল পন্থা অবলম্বন করে ফেলে। সেটা হচ্ছে ইসলাম শান্তির ধর্ম, সুতরাং ইসলাম পালন করা শুরু করলে দুনিয়ার আর কোন সমস্যা থাকবে না বা নির্বিঘ্ন, নিশ্চিন্ত, সুখময় একটা জীবন পাওয়া যাবে। ইসলামের দাবী কখনোই এমন ছিল না যে, কেউ ইসলাম মানা শুরু করলে তার আর কোনো ধরনের সমস্যা হবে না, তার জীবনে আসবে না কোনো বাঁধা, থাকবে না কোনো বিপত্তি। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ফলে পার্থিব বিপদ-আপদ কখনো কমে না, বরং বাড়ে। এমনকি পুরো দুনিয়ার মানুষ শত্রু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা দেখতে পাই যে নবীগণ (আলাইহিমুস সালাম) সব থেকে বেশি পার্থিব সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছেন। তারপর যারাই নবীদের যত নিকটবর্তী ছিলেন, তাদের উপরই বিপদ এসেছে তত বেশি।
সীরাত থেকে আমরা দেখি যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের, সবার নিকট গ্রহণযোগ্য, বিশ্বস্ত এক যুবক। কিন্তু সেই মানুষটিকে নবুওয়াতের নূর আসার পরেই শুরু হল কষ্ট দেয়া। তাঁর বিরোধিতা করার জন্য মক্কার কাফিরগোষ্ঠীরা জঘন্য ও নিকৃষ্ট সব পথ অবলম্বন করেছে । একই আচরণ ছিল ইসলাম গ্রহণকারী সব সাহাবীদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সাথেও। এমনকি এর আগের সব নবী রাসূল ও নেককার লোকদের ক্ষেত্রেও আমরা একই অবস্থাই দেখতে পাই। কিন্তু এত কষ্ট ও বিরোধিতার মুখেও কেউ এই ভেবে পিছিয়ে যাননি যে, ইসলামে এসে শান্তি পাওয়ার পরিবর্তে আরো বিপদে কেন পড়ছি! কারণ ইসলাম আসলে দুনিয়াতে কষ্টমুক্ত জীবনের ওয়াদা করেনি- করেছে আখিরাতে চূড়ান্ত শান্তির ওয়াদা।
পাশাপাশি ইসলামের মৌলিকত্ব এটাই যে এটা সব যুগের সব মানুষকে দুনিয়ার এই সমস্যাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে সেই শিক্ষা দেয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়সহ সব ধরনের সমস্যা সমাধানের রাস্তা আর পদ্ধতি ইসলাম জানিয়ে দেয়। এমনকি এর দুনিয়া- আখিরাতের প্রতিদান কি হতে পারে সেটাও ইসলাম নিশ্চিত করে বলে দেয়। শুধু সমস্যা না, জীবনে ভাল কিছু ঘটলেও কেমনভাবে নিবেন, সেটাও ইসলাম শিখায়। যদি আপনি নিয়ামত পান, তবে ইসলাম আপনাকে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা শিখায়। যদি আপনি বিপদে পড়েন, ইসলাম আপনাকে ধৈর্য ধরতে শিখায়। সেই বিপদকে কিভাবে মোকাবেলা করবেন কিংবা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বা বিভিন্ন মানুষের সাথে কিভাবে আচরণ করবেন সেটা শেখায়। আর সব ক্ষেত্রে ইসলাম মেনে চলতে পারলেই আপনার জন্য রয়েছে সফলতা। তবে সুনির্দিষ্ট ফলাফলের ব্যাপারে আমরা অজ্ঞ, সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। সুতরাং ইসলামে প্রবেশ করা বা ইসলাম পালন করা মানে ইসলামের এই দেখানো পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে সমস্যা মোকাবেলা করা আর ফলাফলের জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করা ও তাঁর মুখাপেক্ষী হওয়া।
প্রিয় ভাই! প্রত্যেক মুসলিমের জীবনেই সমস্যা আছে, আছে পরীক্ষা। নারীর ফিতনা, ধনসম্পদের ফিতনা, হারাম থেকে বেঁচে থাকতে স্বপ্নের ক্যারিয়ারকে (চাকরী বা ব্যবসা) জলাঞ্জলি দেয়া, নিজের প্রিয়জনকে ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমানো এগুলো তো আছেই। এমনকি কোনো জিহাদি তানজিমের সাথে যোগ দিলেই বা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেলেই যে সবার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি মনে করাও বাস্তবসম্মত নয়।
শায়েখ আবু কাতাদা (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন,
"...একইভাবে, মানুষ জিহাদ নিয়ে কথা বলে যেহেতু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্
অত্যন্ত শ্রুতিমধুর একটি শব্দ। কিন্তু বাস্তব জিহাদ, জিহাদের প্রতিটি
ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু সুখকর নয়। জিহাদ কোনো ঝংকার তোলা বক্তৃতা বা সুন্দর
সুন্দর কথার নাম নয়। জিহাদ মানেই গনীমত কিংবা বন্দীলাভ নয়। আর জিহাদ কোনো
অনলবর্ষী বক্তার বক্তৃতাও নয়।
বরঞ্চ, জিহাদের মাঝে রয়েছে প্রিয়
ব্যক্তিদের মৃত্যু, বন্ধুর আহত হওয়ার দৃশ্য, মাথার ঠিক উপর দিয়ে শেল উড়ে
যাওয়া, ধনসম্পদ হারিয়ে ফেলা এবং কোনো সাহায্যকারী না থাকা। বরং অন্যভাবে
বলতে গেলে, জিহাদের মাঝে রয়েছে সর্বপ্রকারের ভয়ংকর সব কষ্ট।
জিহাদের ময়দানে সৈন্যসমাবেশ ঘটে। মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হয়ে থাকে। এ তাকে মারে, সে তাকে ধরে, ও ঝগড়া করে ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বোপরি জিহাদ হলো গণআন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই তাই এর মাঝেও রয়েছে ভুলভ্রান্তি, ইজতিহাদ, অপব্যাখ্যা ইত্যাদি। কখনো বিষয়গুলো সুখকর হয়, কখনো হয় না। এখানেও রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা; সুখকর কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যকার এক বিরাট ব্যবধান।
আমরা যদি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মানুষের কাল্পনিক ধ্যানধারণা ও চিন্তাচেতনার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, অধিকাংশ মানুষ স্বপ্নের জগতে বসবাস করছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। তাদের এই স্বপ্নের জগতে রয়েছে মনোরম দৃশ্যাবলী, অভিবাদন জানানোর জন্য গালিচা, মনোমুগ্ধকর রঙিন সব দৃশ্যকল্প আর সর্বদা বৃষ্টি বর্ষণকারী সুবিশাল এক আকাশ ইত্যাদি। আর শত্রুরা যেন সদাসর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে এই ভেবে যে, যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাগণ সার্বক্ষণিক আমাদের সাথে থেকে যুদ্ধ করে। তারা ভাবতে ভালোবাসে যে, ইসলামী রাষ্ট্রে থাকবে না দারিদ্র্য আর অসুস্থতা। তারা যা চাইবে তার সবই তাদের সামনেই থাকবে। কিন্তু যদি আমরা নবী সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাষ্ট্রের দিকে তাকাই তাহলে তা জান্নাততূল্য দেখতে পাব কি?
বরঞ্চ আমরা দেখতে পাব যে, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রে সাহাবাদের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) যন্ত্রনা-দুর্ভোগ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে)মক্কার চাইতেও বেশি ছিল। সাহাবায়ে কেরামের (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) খন্দকের যুদ্ধের ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন কি মক্কাতে হয়েছিলেন?
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
إِذْ جَاؤُوكُم مِّن فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنكُمْ وَإِذْ زَاغَتْ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّونَ بِاللَّهِ الظُّنُونَا
“যখন তারা তোমাদের কাছে উপর-নিচ থেকে আসছিল তখন তোমাদের চোখ বিস্ফোরিত হচ্ছিল, প্রাণ কণ্ঠাগত হচ্ছিল। আর তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে বিভিন্ন ধারণা করছিলে। তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তারা প্রবলভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল”। (সূরা আহযাব, ৩৩:১০-১১)
(শায়েখ আবু কাতাদার কথা এখানে শেষ)
আমরা আরও জানি, খুলাফায়ে রাশিদীনের
তিনজনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ,খারেজিদের ফিতনা, হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকান্ড,
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শেষ জীবনের ঘটনাবলি - এগুলো
তো এমন ঘটনা যা কিনা একজন শিশুকে বৃদ্ধ বানিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে-ইমান ও আমালে সালেহের উপর অটল থেকে সবর করে কষ্ট ও কুরবানির একটা স্তর পার হলে, তামকিন ও খিলাফত অর্জনের আসবাব সঠিক ভাবে গ্রহণ করলে আল্লাহ তায়ালা তামকিন ও খিলাফতের পুরষ্কার দান করেন এবং নিঃসন্দেহে খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নুবুয়াহ এর আওতায় মুমিনরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা লাভ করে সেটা দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে উত্তম রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেখানে ভয় কিংবা ত্রাসের রাজত্ব নয়-বরং মৌলিকভাবে নিরাপত্তা বিরাজ করে। মুমিনরা সামগ্রিকভাবে সাচ্ছন্দের জীবন যাপন করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সেখানে বসবাসকারী কোন মুমিনের জীবনে কোনো ধরনের ভয় ভীতি বিপদ আপদ থাকবেনা, বরং সেখানেও চ্যালেঞ্জ থাকে, জিহাদ থাকে, শত্রুর মুকাবেলা থাকে, ঈমানি জীবনের পরীক্ষা থাকে। আল্লাহ তায়ালা খেলাফত ও তামকিন দিয়েও এটা পরীক্ষা করেন-যে মুমিনরা কেমন আমল করে। খেলাফতের হক কিভাবে আদায় করে, এর হেফাজত, সম্প্রসারণ কতটুকু করে, ইনসাফ কায়েম, সলাত কায়েম কতটুকু করে ইত্যাদি। আর এ পরীক্ষা দিতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন কষ্টের মুখোমুখি হতে হবে। (দ্রষ্টব্যঃসূরা নূর-৫৫,সূরা আরাফ-১২৯)
অতএব, ইসলাম পালন করলে আর কোনো সমস্যা আসবে না - এই চিন্তা ভুল। সমস্যা এসেছিল সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্মের মানুষগুলোর জীবনেও। তবে ইসলাম আপনাকে শিখাবে কিভাবে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে।
আল্লাহ কখন আপনাকে চিনে নিবেন?
এই যে ইসলামে আসার ফলে যে সমস্যা আর পরীক্ষা তার কারণ আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি আমাদের পরীক্ষা করে নিতে পারেন - আমরা কি ইহকালীন জীবনটা মুমিন হিসেবে আল্লাহর ইবাদাতে কাটালাম নাকি তার সাথে কুফরি করলাম। অর্থাৎ, এই দুনিয়া হচ্ছে মানুষের জন্য একটি পরীক্ষাক্ষেত্র।
আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন,
أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتْرَكُوٓا۟ أَن يَقُولُوٓا۟ ءَامَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
وَلَقَدْ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْۖ فَلَيَعْلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُوا۟ وَلَيَعْلَمَنَّ ٱلْكَٰذِبِينَ
লোকেরা কি মনে করে যে ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; অতঃপর আল্লাহ অবশ্য অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী। [সূরাহ আল-আনকাবূত, আয়াত ২-৩]
কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, এই পরীক্ষাটা মূলত কখন হয়? কোন সময়টাতে আল্লাহ আমাদেরকে চিনে নেন? কি সেই (পরীক্ষা)?
যখন দ্বীনের পথে চলতে গিয়ে আমাদের জীবনে ঝড়-তুফান আসে, কঠিন সময় আসে, তখনই আমাদের আসল রূপ বোঝা যায়। সহজ সময় দ্বীন পালন মুনাফিকরাও করে, নিফাক বের হয়ে আসে কঠিন সময়ে, পরীক্ষা আসলে। দুনিয়াবি বিষয়ের ক্ষেত্রেও বন্ধু ও আপনজনদের আসল রূপ চেনা যায়, যখন বিপদ আসে তখন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ
الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ وَتِلْكَ الأيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ
النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ
شُهَدَاء وَاللّهُ لاَ يُحِبُّ الظَّالِمِينَ
"তোমরা যদি আহত হয়ে থাক, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ জানতে চান কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।" [সূরাহ আলে ইমরান,আয়াত- ১৪০]
চিন্তা করুন। যদি মুসলিমরা সব সময় শক্তিশালী থাকতো, তাহলে পরীক্ষা হতো কিভাবে? বরং আরামের সময় মুনাফিকরা পর্যন্ত জিহাদে অংশগ্রহণ করে।
لَوْ كَانَ عَرَضًا قَرِيبًا وَسَفَرًا قَاصِدًا لاَّتَّبَعُوكَ وَلَـكِن بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ الشُّقَّةُ
"যদি আশু লাভের সম্ভাবনা থাকতো এবং যাত্রাপথও সংক্ষিপ্ত হতো, তবে তারা অবশ্যই আপনার সহযাত্রী হতো, কিন্তু তাদের নিকট যাত্রাপথ সুদীর্ঘ মনে হল।" [সূরাহ তওবা, আয়াত- ৪২]
তাই, পরীক্ষা করার নিমিত্তেই আল্লাহ আমাদেরকে বিপদে ফেলবেন। আমাদের অবস্থা যাচাইয়ের জন্য। যেন আল্লাহ চিনে নেন আমাদের সত্যতা। এটিই তো পরীক্ষার উদ্দেশ্য। আর যারা আল্লাহর রাস্তায় মারা যাবে, তাদেরকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করবেন। এটা তাদের জন্য দারুণ মর্যাদার বিষয়। অতএব, যদি আমরা বিপদে আল্লাহর পথে অটল থাকতে পারি, তবে কোনো দিক দিয়েই আমাদের বিফলতা নেই। বরং আছে মহা সাফল্য।
খারাপ অবস্থার মূল বিষয়টাকে আমাদের অনুধাবন করতে হবে। এটি আমাদের ইসলাহের জন্য জরুরী। এটি মুসলিমদের কাতারকে পরিশুদ্ধ করবে এবং মুমিন ও মুনাফিকদের তাঁবুকে পৃথক করবে। নিশ্চয় বিজয়ের অবস্থায় সবাই সাথে থাকে। নিশ্চয় পরাজয়ের অবস্থায় মুনাফিকরা সরে যায়। আর এর চূড়ান্ত ফয়সালা হবে কেয়ামতের দিন।
الَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِن كَانَ لَكُمْ فَتْحٌ مِّنَ اللّهِ قَالُواْ أَلَمْ نَكُن مَّعَكُمْ وَإِن كَانَ لِلْكَافِرِينَ نَصِيبٌ قَالُواْ أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُم مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ فَاللّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَن يَجْعَلَ اللّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلاً
"এরা এমনি মুনাফেক যারা তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণের প্রতীক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকে। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের যদি কোন বিজয় অর্জিত হয়, তবে তারা বলে, আমরাও কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? পক্ষান্তরে কাফেরদের যদি আংশিক বিজয় হয়, তবে বলে, আমরা কি তোমাদেরকে ঘিরে রাখিনি এবং মুসলমানদের কবল থেকে রক্ষা করিনি? সুতরাং আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কেয়ামতের দিন মীমাংসা করবেন এবং কিছুতেই আল্লাহ কাফেরদেরকে মুসলমানদের উপর পথ খুলে দিবেন না।" [সূরাহ নিসা, আয়াত- ১৪১]
পরীক্ষা মানেই কষ্ট। মুমিন মাত্রই দ্বীনের জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে। আর তাই, নিজেকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে যারা দ্বীনের কাজে পিছিয়ে যাবে আল্লাহ তাদেরকে ছাড় দিবেন না, বরং তাদেরকে পাকড়াও করবেন।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
وقد قضى الله تعالى قضاء لا يُرد ولا يدفع أن من أحبّ شيئاً سواه عُذِّب به ولا بد، وأن من خاف غيره سُلّط عليه، وأن من اشتغل بشيء غيره كان شؤماً عليه، ومن آثر غيره عليه لم يبارك فيه، ومن أرضى غيره بسخطه أسخطه عليه ولا بد
"আল্লাহ এমন একটি ফয়সালা করেছেন যা প্রতিহত করা বা যার বিরুদ্ধে যাওয়া অসম্ভব। সেটি হচ্ছেঃ
যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কিছুকে ভালবাসবে, নিশ্চিতভাবে ঐ বিষয়ই তার যন্ত্রণার কারণ হবে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে ভয় করবে তার উপর ঐ ভয়ের বিষয়টিই চাপিয়ে দেয়া হবে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছু নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে, ঐ বিষয়ই তার জন্য দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের কারণ হবে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অধিক প্রাদান্য দিবে, সে দেখবে যে তার কাজ থেকে আল্লাহ প্রদত্ত বরকত উঠে গেছে।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে অন্য কাউকে সন্তুষ্ট করবে আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তিকেও তার উপর অসন্তুষ্ট করে দিবেন"
(আল ওয়াবিলুস সায়্যিব মিনাল কালিমিত তায়্যিবঃ১৪ -দারু ইবনি হাযম)
ভেবে দেখুন, এই দুনিয়া অতি তুচ্ছ এক জায়গা। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে এই দুনিয়ার মূল্য একটা মশার ডানার সমপরিমাণও নয়। কিসের লোভে আপনি আল্লাহর কাজ থেকে পিছিয়ে যাবেন? স্ত্রী? পরিবার পরিজন? ধনসম্পদ? চাকরী/ব্যবসা? সামান্য এসব দুনিয়ার বস্তুর কারণে আল্লাহ'র কাজে পিছিয়ে যাবেন?
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,
قُلْ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَٰنُكُمْ وَأَزْوَٰجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَٰلٌ ٱقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرْضَوْنَهَآ أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِى سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِىَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الفاسِقِينَ
বল, ‘যদি তোমাদের পিতারা, তোমাদের সন্তানেরা, তোমাদের ভাইয়েরা, তোমাদের স্ত্রীরা, তোমাদের গোষ্ঠীর লোকেরা এবং ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর ব্যবসা তোমরা যার মন্দার ভয় কর, আর বাসস্থান যা তোমরা ভালবাস (এসব) যদি তোমাদের নিকট প্রিয়তর হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা হতে, তাহলে অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফয়সালা তোমাদের কাছে নিয়ে আসেন।’ আর আল্লাহ অবাধ্য আচরণকারীদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না। [সূরাহ আত-তাওবাহ, আয়াত ২৪]
এজন্য আমাদের জীবনটা আল্লাহর রাস্তায় বিসর্জন দিতে হবে। পরীক্ষা আসলে অটল-অবিচল থাকতে হবে। আমরা যেন মুনাফিকদের মত হয়ে না যাই, যারা সহজ সময়ে দ্বীন পালন করে, আর পরীক্ষা আসলে পিছু হটে যায়। আল্লাহ আমাদের দৃঢ়পদ রাখুন। আমিন।
ওয়াল্লাহু তা'আলা আ'লাম।

0 মন্তব্যসমূহ