লড়াইটা কার বিরুদ্ধে হবে?

 লড়াইটা কার বিরুদ্ধে হবে?


লড়াইটা সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে হবে, নাকি হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে হবে, এ ব্যাপারে আলাপ হতে পারে। কিন্তু যারা হিংদুত্ববাদকে পরাজিত করার সামর্থ্য রাখেন, তারা সেক্যুলার কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রাখবেন এটি আসলে ফল্স ডাইকটমি। যা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে শেষপর্যন্ত হিংদুত্ববাদের মুখোমুখি হওয়া। আবার হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে, আপনাকে সেক্যুলার কাঠামের মুখোমুখী হতে হবে। কারণ, এই দেশে সেক্যুলার কাঠামোর মূল অনুঘটক, যাকে আমরা ডিপ স্টেট বলি, সেটি আসলে ‘হিংদুত্ববাদ’।

.
বিষয়টি সরলভাবে বোঝা যাক। হিংদুত্ববাদকে সত্যিকার অর্থে ধ্বংস করতে হলে আপনাকে অবশ্যই সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কারণ, দৃশ্য ও অদৃশ্যভাবে এই কাঠামোই হিংদুত্ববাদের পৃষ্ঠপোষক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুতে এই শক্তিটি সক্রিয় রয়েছে, যা মুসলিম স্বার্থের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকে।
আবার সেক্যুলার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হিংদুত্ববাদকে পরাজিত করতে হবে, কারণ এটি তার প্রাণশক্তি।
.
হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই কোনো সাময়িক আবেগ বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী আদর্শিক সংগ্রাম। এই উপমহাদেশে ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রধান শত্রু নিঃসন্দেহে উগ্র-হিংদুত্ববাদ। এবং এটি একটি সম্প্রসারণবাদী আদর্শ, যা পুরো উপমহাদেশ থেকে মুসলিম উপস্থিতিকে নির্মূল বা দুর্বল করার স্বপ্ন দেখে। কাশ্মীর থেকে শুরু করে গুজরাট, আসাম থেকে উত্তরপ্রদেশ—সর্বত্র হিংদুত্ববাদী আগ্রাসনের ছাপ স্পষ্ট।
.
কাশ্মীরের কথাই ধরা যাক। যদি আপনি কাশ্মীরে প্রতিরোধ করতে চান, তাহলে আপনার লড়াইটা কার বিরুদ্ধে হবে? ভারতীয় সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে, নাকি হিংদুত্ববাদী ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে? এই প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার। কাশ্মীরে যে নিপীড়ন চলছে, তা ভারতের ‘সেক্যুলার সংবিধান’ চালাচ্ছে না, বরং চালাচ্ছে হিংদুত্ববাদী আদর্শ এবং আধিপত্যবাদ। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিল পর্যন্ত—প্রতিটি পদক্ষেপ হিংদুত্ববাদী প্রকল্পের অংশ।
কাশ্মীরের কোনো প্রতিরোধ আন্দোলন যদি মনে করে যে, তারা ‘ভারতীয় সেক্যুলারিজমের’ বিরুদ্ধে লড়বে, তাহলে সেই আন্দোলন জনমনে কোনো প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করতে পারবে না।
.
গুজরাটের গণহত্যা, আসামের NRC, উত্তরপ্রদেশে বুলডোজার চালিয়ে মুসলিমদের বসতি উচ্ছেদের পেছনে কাজ করছে কোন শক্তি? এটি কি সেক্যুলার সংবিধান, নাকি হিংদুত্ববাদী মতাদর্শ? উত্তরটি সবার জানা।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা চলেছে, সেটিও চালিয়েছে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী শক্তি, সেক্যুলার রাষ্ট্রকাঠামো এখানে নিছক হাতিয়ার মাত্র।
ফিলিস্তিনে লড়াইটা ইস.রা.য়েলি ‘গণতন্ত্র’ বা ‘সেক্যুলারিজমের’ বিরুদ্ধে নয়, বরং ই.খু.দিবাদী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। এই প্যাটার্ন সর্বত্র লক্ষণীয়।
.
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল এবং সূক্ষ্ম। শায়েখ ওমর আবদুল হাকিম “দুর্বলদের প্রতিরোধের” যে তিনটি প্রত্যক্ষ কারণ উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে দুটি কারণ এই দেশে স্পষ্ট। প্রথমত, পরোক্ষ দখলদারিত্ব যেখানে ভারতের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে দেশীয় সেক্যুলার শক্তি এবং বাইরের হিংদুত্ববাদী আধিপত্যের সমন্বয়ে মুসলিম জনগণকে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। এবং এই পরোক্ষ দখলদারিত্ব ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ দখলদারিত্বে রূপান্তরিত হচ্ছে।
.
যেকোনো আন্দোলন/সংগ্রামের জন্য একটি যৌক্তিক ভিত্তি বা ‘مفتاح الصراع’ (প্রতিরোধের চাবি) প্রয়োজন। যেকোনো অঞ্চলে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করতে হলে এমন একটি কেন্দ্রীয় বিষয় খুঁজে বের করতে হয়, যা জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত করতে পারে এবং তাদের মধ্যে লড়াইয়ের যৌক্তিকতা তৈরি করতে পারে। এই অঞ্চলে ‘মিফতাহুস সিরাআ’ কি সেক্যুলার কাঠামো, নাকি হিংদুত্ববাদ?
.
সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ, সুশাসন এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে সহনীয়, এমনকি গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। কিন্তু হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই জনগণের কাছে অনেক বেশি দৃশ্যমান এবং প্রাসঙ্গিক।

গাজওয়াতুল হিন্দের যে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, সেখানেও বিষয়টি স্পষ্ট। সেই যুদ্ধ মুসলিম এবং মুশরিকদের মধ্যে সংঘটিত হবে, সেক্যুলারিস্ট এবং ইসলামপন্থীদের মধ্যে নয়। এটি একটি আকিদাগত এবং আদর্শিক সংগ্রাম, যেখানে তাওহিদ এবং শিরকের মধ্যে চূড়ান্ত মীমাংসা হবে। এবং শিরকের মূলোৎপাটন না হলে এই লড়াই থামবে না। আপনি যদি এদেশে সেক্যুলার কাঠামোকে পরাজিত করতেও পারেন, তবুও আপনাকে উপমহাদেশের সাপের মাথা ‘উগ্র-হিংদুত্ববাদ’কে মোকাবেলা করতেই হবে।

.
সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যত মানুষকে রিলেট করা যাবে, হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক এবং স্বতঃস্ফূর্ত মানুষকে সংযুক্ত করা সম্ভব। কারণ, হিংদুত্ববাদের হুমকি বাস্তব এবং দৃশ্যমান। অন্যদিকে সেক্যুলার কাঠামোর বিপদ অনেক বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদী, যা সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করে না।
.
সেক্যুলার কাঠামো এবং হিংদুত্ববাদ, দুটোই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একটির সমর্থনে অন্যটি টিকে আছে। তাই যেকোনো বাস্তবসম্মত প্রতিরোধ আন্দোলনে উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোনটিকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে এবং কোন যুক্তিতে জনগণকে একত্রিত করতে হবে?
.
যদি হিংদুত্ববাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে আন্দোলনের জনভিত্তি হবে বিশাল ও শক্তিশালী। মানুষ বুঝবে তারা কেন এবং কার বিরুদ্ধে লড়ছে। একইসঙ্গে সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াইও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে যাবে, কারণ এই কাঠামো সেই শত্রুর পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু যদি শুধুমাত্র সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াইকে সীমিত করে ফেলা হয়, তাহলে এই আন্দোলন সীমিত গণ্ডির মধ্যে আটকে যাবে এবং মূল ও প্রকৃত হুমকি ‘হিংদুত্ববাদ’ আড়ালে চলে যাবে বা অপ্রধান হয়ে থাকবে।
.
হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সামর্থ্য এবং সাহস শুধুমাত্র তাওহিদের ধারকদের রয়েছে। সেক্যুলার কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়তে অনেকেই দাঁড়াতে পারে। কিন্তু হিংদুত্ববাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সেটি একটি আদর্শিক এবং আকিদাগত সংগ্রাম হওয়ায় এই লড়াইয়ে আপোষের কোনো সুযোগ বা মধ্যপন্থা নেই। হয় তাওহিদ প্রতিষ্ঠিত হবে, নয়তো শিরক টিকে থাকবে। এই ধরনের নিঃস্বার্থ এবং নীতিগত অবস্থান শুধুমাত্র তারাই নিতে পারেন, যারা তাওহিদের অনুসারী এবং শিরকের সঙ্গে কোনো ধরনের সহাবস্থানে বিশ্বাসী নন।
.
তাই চূড়ান্ত কথা হলো, উপমহাদেশের মুসলিমদের প্রধান ও প্রকৃত শত্রু হিংদুত্ববাদ। সেক্যুলার কাঠামো সেই শত্রুর পৃষ্ঠপোষক এবং সহযোগী। দুটির বিরুদ্ধেই একযোগে লড়তে হবে, কিন্তু হিংদুত্ববাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে লড়াই এগিয়ে নিতে হবে। কারণ এটিই ‘মিফতাহুস সিরাআ’—জনগণকে সংঘবদ্ধ করার মূল চাবিকাঠি। এবং এই সংগ্রাম তাওহিদের পতাকাতলে, শিরকের মূলোৎপাটনের মাধ্যমেই বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ।

~ সাঈদ আবরার

0 মন্তব্যসমূহ