সঠিক পরিচয়ের ব্যাখা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে মুসলিম - অমুসলিম লেখকরা অনেকেই অনেক কিছু লিখেছে। কেউ তাঁকে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্লেষণ করেছে, কেউবা বলেছে একজন দক্ষ সমরনায়ক, আবার কেউ দেখেছে কূটনৈতিক চাতুর্যের চোখে।
এসব বিশ্লেষণ অস্বীকার করছি না, কিন্তু একটা গভীর প্রশ্ন করি, এইসব গুণাবলির মধ্যে কোনটি ছিল তাঁর জীবনের মূল পরিচয়? মূল পরিচয় হলো, তিনি ছিলেন একজন নবী। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত।
এই পরিচয়টাই ছিল তাঁর জীবনের কেন্দ্রে। এই পরিচয়কে বাদ দিয়ে বাকি সব বিশ্লেষণ নিছক খণ্ডিত, বিভ্রান্তিকর, এমনকি বিপজ্জনকও।
প্রাচ্যবিদরাও ঠিক এই কাজটাই করেছে। তারা রাসূলকে ভালোবাসার কথা বলেছে, মানবিক গুণের প্রশংসা করেছে, কিন্তু তাঁর নবুয়্যতের দাবিকে পাশ কাটিয়ে গেছে।
তাঁর জীবনের মূল মিশন তাওহীদ প্রতিষ্ঠা, শিরকের বিরুদ্ধে লড়াই, ওহীর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ এসব নিয়ে তারা চুপ থেকেছে।
অনেক মুসলিম লেখকও সেই পথেই হেঁটেছেন। হয়ত অজান্তেই তারা সীরাতকে একটি মানবিক আদর্শের গল্পে রূপ দিয়েছেন।
কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সীরাত মানে শুধু ইতিহাস নয়, বরং এটা তাওহীদের ডাক ও ওহীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর বিপ্লবের নাম।
এই ভুলটি আজ আমরা রাষ্ট্রচিন্তায়ও করছি। আমরা আজ ইসলামী রাষ্ট্রের কথা বলি, কল্যাণরাষ্ট্রের কথা বলি, ন্যায়বিচারের কথা বলি। কিন্তু এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রে যদি তাওহীদ না থাকে, ওহীর প্রতি আনুগত্য না থাকে, তাহলে সেটা ইসলামী রাষ্ট্র হলো কীভাবে?
ক.
ইসলামে রাষ্ট্র মানে এমন এক কাঠামো, যার ভিত্তি হলো—
১. আল্লাহই সর্বোচ্চ মালিক ও আইনপ্রণেতা।
২. রাসূলের (সা.) অনুসরণই হলো পূর্ণ আনুগত্যের পথ।
৩. মানুষ নয়, আল্লাহর হুকুমই চূড়ান্ত।
খ.
এই ভিত্তি না থাকলে সেই রাষ্ট্রের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ইসলামী ফিকহে নেই। বরং উলামায়ে কেরাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, এমন রাষ্ট্র যদি তাওহীদ ও ওহী থেকে বিচ্যুত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ইমানের দাবি হয়ে যায়।
গ.
দুঃখের কথা হলো, আমরা যখন "কল্যাণরাষ্ট্র", "নৈতিক রাষ্ট্র", "জনবান্ধব রাষ্ট্র" ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করি, তখন অনেক সময় এসব শব্দ দিয়ে মূল প্রশ্নটা ঢেকে ফেলি। আমরা যেন চুপচাপ স্বীকার করে নিয়েছি যে, ওহী ছাড়াও একটা ভালো রাষ্ট্র সম্ভব।
এই ধারণাটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
ঘ.
সেকুলারিজম, লিবারেলিজম, ডেমোক্রেসি, এরা কেউই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানে না। এদের মূল দর্শনই হলো, "মানুষই সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তদাতা"। তাহলে এই দর্শনের সাথে তাওহীদের সংঘর্ষ কি কেবল রাজনৈতিক? না, এটা তো একেবারে ঈমানের প্রশ্ন!
ঙ.
যারা ইসলামী রাষ্ট্র কল্পনা করতে চান, তাদের আগে স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে—
১) ওহীহীন রাষ্ট্র কখনো ইসলামী রাষ্ট্র হতে পারে না।
২) কল্যাণ, সুবিচার, সমতা—এসব তখনই মূল্যবান, যখন ওহীর ছায়ায় থাকে।
৩) নাহলে এরা শূন্যে ভেসে থাকা শব্দ মাত্র।
আমরা যদি এই মূল সত্যটিকে উপেক্ষা করি, তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন কাগজে আঁকা ছবি হয়েই থাকবে। তাওহীদ ও ওহীর বার্তাকে রাষ্ট্রকাঠামোর কেন্দ্রস্থানে না বসাতে পারলে, কাঠামো যতই পরিবর্তন হোক, তা হবে কেবল রঙ বদল, প্রকৃতি নয়।
এই জায়গাটাতেই আজ আমাদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নইলে আমাদের কথাই হবে, সীরাত নিয়ে আলোচনা করেও রাসূলের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করা মানুষদের মতো।
সাইদুল ইসলাম আকাশ
0 মন্তব্যসমূহ