অসীম দ্বন্দ্বের মৌলিক ক্ষেত্রসমূহ

 

অসীম দ্বন্দ্বের মৌলিক ক্ষেত্রসমূহ


=================================================

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم

  إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه .  أمابعد

 

 

মাকসাদ: অসীম দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো - এখানে একই সময়ে একাধিক শত্রুর সাথে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হয়।


অসীম দ্বন্দ্ব কেবল সামরিক যুদ্ধের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অসীম দ্বন্দ্বের একাধিক ক্ষেত্র রয়েছে।  দুটো জাতির মধ্যকার অসীম দ্বন্দ্বে তিনটি মৌলিক ক্ষেত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় :

 

১. আদর্শিক ক্ষেত্র 
২. সামরিক ক্ষেত্র 
৩. অর্থনৈতিক ক্ষেত্র

 

অসীম দ্বন্দ্বের মৌলিক এ ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করাই আমাদের এ সবকের মাকসাদ।

 

 

দুটো জাতির মধ্যকার অসীম দ্বন্দ্বে যেসব ক্ষেত্র থাকে তার মধ্যে তিনটি মৌলিক ক্ষেত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। প্রথমেই উল্লেখ করা যায় আদর্শিক দ্বন্দ্বের কথা - 


১. আদর্শিক ক্ষেত্র


এটি অসীম দ্বন্দ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট। কারণ, আমাদের সামরিক সংঘাত, অর্থনৈতিক সংগ্রামসহ সকল কিছু আমাদের আদর্শকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। আমরা তাওহীদের উপর অটল অবিচল থাকার জন্যই কিতাল করি, তাওহীদের আলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতেই আমরা জিহাদ করি।


যদি তাওহীদের উপর অটল থাকা অবস্থায় সামরিক যুদ্ধে আগ্রাসনের শিকার হয়ে আমরা সবাই শাহাদত বরণ করি, সবাই যদি নি:শেষও হয়ে যাই, তবু আমরা বিজয়ী ও সফল। অন্যদিকে সামরিক ক্ষেত্রে যদি আমরা উন্নতির চূড়ান্ত শিখরেও পৌঁছি, কিন্তু তাওহীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই, তাহলে আমরা ব্যর্থ ও বিফল।


সুরা বুরুজে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ওই মুমিনদের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যাদেরকে আসহাবুল উখদুদ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিল। কিন্তু ওই মুমিনরা কি পরাজিত হয়েছিলেন? 


কক্ষনো না। বরং তারাই ছিলেন বিজয়ী। সুরা বুরুজে আল্লাহ তাবারকা ওয়া তায়ালা ঈমানের উপর তাদের এই অবিচল থাকাকে "আল ফাউজুল আজীম" তথা মহাসাফল্য বা মহাবিজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিয়ামত পর্যন্ত সকল মুমিনের জন্য তাদেরকে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন।


২. সামরিক ক্ষেত্র

 

অসীম দ্বন্দ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো সামরিক ক্ষেত্র। 
সামরিক যুদ্ধ বা কিতাল ছাড়া পৃথিবীতে কোনো দিন কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, টিকেও থাকতে পারেনি। তাই, আদর্শিক যুদ্ধে সফলভাবে টিকে থাকার জন্য অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হলো সামরিক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। এমনকি আমেরিকাতে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্বিতালের মাধ্যমে। যা আমেরিকান সিভিল ওয়ার বা আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলে সবাই জানেন।


আল্লাহ তায়ালা বলেন -

 

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ‎﴿٤٠﴾

"যদি আল্লাহ তায়ালা মানুষদের এক দলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে বিধস্ত হয়ে যেত (খৃস্টান সন্ন্যাসীদের) আশ্রম, গির্জা, (ইয়াহূদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। [সুরা হজ: ৪০]


নিজেকে সামরিক দ্বন্দ্ব থেকে সরিয়ে রাখাও আসলে আদর্শ থেকে একধরনের বিচ্যুতি।

হাদীসে এসেছে -

 

 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ ‏"‏ ‏

" যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলো, অথচ জিহাদ করলোনা, এবং নিজের মনকেও  জিহাদের কথা বললোনা (অর্থাৎ জিহাদের নিয়্যত করলোনা)  সে নিফাকের একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করলো" [ সহীহ মুসলিম: কিতাবুল ইমারাহ, ৪৭৭৮ ]


পূর্বের সবকগুলোতে আমরা অসীম দ্বন্দ্বের যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো পড়েছি তার সবগুলোই আমরা সামরিক যুদ্ধের মাঝে পাবো। তাই এটা খুবই স্পষ্ট যে, সামরিক সংঘাত কোনো সসীম দ্বন্দ্ব নয় এবং সসীম মানসিকতা নিয়ে এই দ্বন্দ্বে নামা কোনোভাবেই সমীচিন নয়।

 

৩.অর্থনৈতিক ক্ষেত্র


অসীম দ্বন্দ্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো অর্থনীতি। অসীম দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক লড়াইয়ের গুরুত্ব আমরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ থেকেই বুঝতে পারি। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। 


অসীম দ্বন্দ্বের উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো অর্থনৈতিক সংঘাতের মধ্যে তার সবগুলো বিদ্যমান। কুফফারদের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক সংঘাত সবসময় ছিলো, আছে এবং থাকবে। এটা কখনোই থেমে যাবেনা। 


যুগে যুগে অর্থনৈতিক যুদ্ধের কৌশল বদলেছে, নিয়ম পাল্টেছে। নির্দিষ্ট কোনো একটি নিয়মে এ দ্বন্দ্বকে বেঁধে রাখা যায়নি। শিআবে আবি তালেবে অবরোধ ও অর্থনৈতিক বয়কটের মাধ্যমে মুসলিমদেরকে নিঃশেষ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার, নিকট অতীতে উপনিবেশের মাধ্যমে মুসলিমদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, বিশ্বব্যাংক, ডলারভিত্তিক অর্থনীতি, সুদী ঋণের ফাঁদ, খনিজ সম্পদে দখলদারিত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক আগ্রাসন চলমান আছে। ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন হঠাৎ করেই পৃথিবীবাসীকে স্তদ্ধ করে দিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন এখন থেকে ডলারের বিপরীতে আর কোনো স্বর্ণ থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। এরপর ওপেকভূক্ত দেশগুলো শুধুমাত্র ডলারের মাধ্যমেই তেল বিক্রি করবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ডলার কেবলই কাগজের একটি মুদ্রা হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আমদানি-রফতানিতে ডলারের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে এবং  ডলারের আধিপত্য ও আগ্রাসনের শিকার হয়।


এক প্রতিপক্ষের পর আরেক প্রতিপক্ষ এসেছে। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হয়ে যায়নি। কুরাইশের কাফেরদের পর রোম-পারস্য, ক্রুসেডারদের পর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো, এরপর আমেরিকা-রাশিয়া-চায়না...। 


অর্থনীতিতে ক্রমাগত উন্নয়নের কোনো শেষ নেই। শত্রুর পক্ষ থেকে ক্রমাগত অর্থনৈতিক আগ্রাসনেও কোনো বিরতি নেই। তাই ইনফিনিট মাইন্ডসেট নিয়েই এ দ্বন্দ্বে আমাদেরকে অবতীর্ণ হতে হবে।


যদি প্রশ্ন করা হয়, দোহা চুক্তির পর থেকে তো তালিবান আপাতত সরাসরি কোনো কিতালে লিপ্ত নয়। তাহলে তাঁরা কি এখন অসীম  দ্বন্দ্বে জড়িত আছেন?  যে অসীম মানসিকতা নিয়ে তাঁরা মার্কিনীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন, সে মানসিকতা কি এখনো বজায় আছে?


উপরের পুরো আলোচনা ভালোভাবে পড়ে থাকলে উত্তরটা আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট। নি:সন্দেহে তারা এখনো লড়াই করে যাচ্ছেন এবং এখনো আগের মতোই অসীম মানসিকতা নিয়েই ইনফিনিট দ্বন্দ্বের মৌলিক ফ্রন্টগুলোতে তারা লড়ছেন।
আদর্শিক যুদ্ধটা তো তারা করেই যাচ্ছেন। শত প্রতিকূলতা ও চাপ সত্ত্বেও তাঁরা ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। বলা যায় মুসলিম বিশ্বের আদর্শিক প্রতিনিধি একমাত্র রাষ্ট্রই হচ্ছে ইমারাতে ইসলামিয়া।


অর্থনীতিতেও তারা ক্রমাগত উন্নয়ন করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সকল নিয়মের বাইরে গিয়ে আমেরিকা অন্যায়ভাবে তাঁদের রিজার্ভ মুদ্রা আটকে রাখার পরেও ইমারাতে ইসলামিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতি প্রতিহত করা যাচ্ছেনা। এসব চাপের মুখে নতি স্বীকার করে কোনো নতজানু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি তালিবান সরকার। এটাই প্রমাণ করে তারা ঠিক আগের মতোই অসীম মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধটা লড়ছেন। দিন দিন আফগানিস্তান অর্থনীতিতে স্বনির্ভর হয়ে ওঠছে আলহামদুলিল্লাহ। এভাবে চলতে থাকলে ইনশাআল্লাহ একটা সময়ে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠবে আফগানিস্তান।


সামরিক ক্ষেত্রেও তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ই'দাদের কাজ করে যাচ্ছেন। সরাসরি এ মুহূর্তে ক্বিতালে না জড়ালেও পরোক্ষভাবে টিটিপি ও আলকায়েদাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন তারা।

 

উপসংহার: অসীম দ্বন্দ্বের অঙ্গন কেবল একটি ক্ষেত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং অসীম দ্বন্দ্বের গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক  ক্ষেত্র আছে। আদর্শিক দ্বন্দ্ব,  সামরিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব - এ সবকিছুই অসীম দ্বন্দ্বের একেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। 


বরং অসীম দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্যই হলো কেউ যদি শুধু একটি ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু  অন্য ক্ষেত্রগুলোকে উপেক্ষা করে তাহলে সে টিকতে পারবেনা। আদর্শিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক - সবগুলো ক্ষেত্রে সুসমন্বিতভাবে অসীম মানসিকতা নিয়ে লড়াই করে যাওয়া এবং ক্রমাগত উন্নয়ন করে যাওয়া ছাড়া টিকে থাকা সম্ভব নয়।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। উম্মাহর দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে উত্তরণ ও জাগরণ দান করুন। আমীন।


ওয়াল্লাহু তায়ালা আ'লাম।

0 মন্তব্যসমূহ