পর্ব-৬ অসীম মানসিকতার আলোচনা তানজিমের কাজের সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত?

 

অসীম মানসিকতার আলোচনা

তানজিমের কাজের সাথে কিভাবে সম্পৃক্ত?

   

=====================================================

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم

  إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه .  أمابعد

 

 

মাকসাদ:  অসীম মানসিকতা সম্পর্কে শুধু তাত্ত্বিক ধারণা লাভ করলে নয়,  বরং কার্যতঃই অসীম মানসিকতাকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে, আমাদের কাজগুলোকে অসীম মানসিকতার আলোকে সাজাতে পারলে, চেতনে-অবচেতনে অসীম মানসিকতার প্রভাব আমাদের সকল চিন্তা ও কর্মে প্রতিফলিত হতে শুরু করলে তখন আমাদের এ দাওরার মাকসাদ সফল হবে।


সে জন্য আমাদের চলমান কাজগুলোকে মুহাসাবা করা এবং অসীম মানসিকতার আলোকে সাজানো জরুরী।
এই বিষয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা প্রদান করাই আমাদের এ সবকের মাকসাদ।

 

 

ক) তানজিমের কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আমরা অনেকেই গাযওয়াতুল হিন্দ বা দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্বপ্ন নিয়েই তানজিমে যুক্ত হই। কিন্তু দিন গড়িয়ে মাস যায়, মাস গড়িয়ে বছর যায়, সেই জিহাদের আনন্দক্ষণ তো আসে না। তাই, অনেক ভাই হতাশ হয়ে ফিরে যায়।

 

কিন্তু আমাদের এ অসীম সফর তো শুধু নির্দিষ্ট একটি যুদ্ধ বা কয়েকটি যুদ্ধসমষ্টির নাম নয়। এটা তো আমরণ এক সফরের নাম। হতে পারে আমাদের জীবদ্দশাতে গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হলো না। আমরা ময়দানের লড়াই এ অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেলাম না। আমাদের পুরো জীবন পার হয়ে গেল লড়াই এর ময়দান প্রস্তুতকরণের কাজে। 

 

আবার আমরা যারা এই বুঝ রাখি তাদের মধ্যে অল্পতেই হতাশা আসে এই নিয়ে যে, নিজে তানজিমের কাজে অবদান রাখতে পারছি না। এখানে একটি জরুরি প্রশ্ন হচ্ছে অবদান বলতে আমরা কি বুঝি। আমরা ভাবি, তানজিমের কোনো কাজ আঞ্জাম দেওয়া যেমন- মিডিয়ার কাজ, আইটির কাজ বা কাউকে রিক্রুট করাটাই কেবল অবদান। কিন্তু তানজিমে যুক্ত হয়েই সঙ্গে সঙ্গে এসব কাজ হাতে পাওয়া কিভাবে সম্ভব, যেখানে একজন ভাই তানজিমের কাজের ধরণ ও চিন্তা চেতনার সাথেই তখনো পুরোপুরি পরিচিত হননি। তাই এক্ষেত্রে একজন ভাইয়ের সবচেয়ে বড় অবদান হবে এটাই যে, তিনি আত্মউন্নয়ন ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে নিজেকে তানজিমের চিন্তা চেতনা ও কাজের সাথে অভ্যস্ত করবেন, তানজিমের নিয়মতান্ত্রিকতা,  রীতি-নীতি, ও নিয়ম-কানুনের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করবেন এবং নিজেকে প্রতিনিয়ত বড় বড় কাজের জন্য যোগ্য করে তুলবেন। আর যেকোনো কাজে অবদান রাখার ক্ষেত্রেও ধাপে ধাপে এর পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। যেমনঃ তানজিমে আপনি প্রথমে ইখওয়া হিসেবে যোগ দেয়ার পর নিয়মিত হাজিরা ও ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেন। আকীদা, মানহাজের ইলম অর্জন করলেন। পাশাপাশি আপনার মাসুল ভাই ইতোমধ্যে আপনাকে নিয়ে যে কাজের পরিকল্পনা করেছেন তার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলেন। হতে পারে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ৬ মাস লাগবে, হতে পারে ১ বছর লাগবে, হতে পারে ৩ বছর লাগবে, এমনকি হতে পারে ১০ বছর লাগবে। তাই বলে হতাশ হয়ে যাবো? কখনো না। একবার ভাবলেই আমাদের বুঝে আসবে যে, অসীম এই লড়াই সসীম মানসিকতা দিয়ে জয় করা সম্ভব নয়।


একজন মাসউল হিসেবে নিজের অধীনের ব্যবস্থাপনাও এমনভাবে সাজাতে হবে যেন তার মাঝে অসীম মানসিকতা ফুটে উঠে। স্বল্প মেয়াদী, মুখরোচক সিদ্ধান্তের দিকে না ঝুঁকে দীর্ঘমেয়াদী, গঠনমূলক, উন্নয়নমূলক, কাঠামোবদ্ধ, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এগিয়ে যেতে হবে।


মানুষের সব দিন সমান যায় না। কখনো ভালো দিন আসে। কখনো খারাপ দিন আসে। কখনো আমাদের কাজ ভালো যাবে, কখনো খারাপ যাবে। এজন্য হা-হুতাশের কিছু নেই। এটাই এই রাস্তার নিয়ম। আমরা সবসময় সমানতালে এগিয়ে যেতে পারব না। উত্থান-পতন চলতে থাকবে। তইফা-মাজমুয়া থেকে শুরু করে তানজিমের মূল কাজের ক্ষেত্রেও, এটাই বাস্তবতা।


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:

 

إِن يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِّثْلُهُ ۚ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَاءَ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ ‎﴿١٤٠﴾‏

‘যদি তোমাদেরকে কোনো আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ যালিমদেরকে ভালবাসেন না’। [সুরা আলে ইমরান, ৩:১৪০]


একটি অসীম বিস্তৃত দ্বন্দ্বে অসংখ্য খণ্ড খণ্ড সসীম দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। আমাদের দৈনন্দিন মুজাহাদা, শয়তান আর নফসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজের ইলম-আমল-আখলাকের পরিসর বাড়ানো একেকটি সসীম বিজয়। আবার সাংগঠনিকভাবে কখনো খুব চমৎকার কিছু কাজ করা, মাসুল বা মামুরের সাথে একেকটা প্রজেক্ট শেষ করা এগুলোও একেকটা সসীম বিজয়। বিপরীত দিকে শয়তানের প্ররোচণায় আমল ছুটে যাওয়া, কোনো গুনাহ হয়ে যাওয়া কিংবা তাগুতের হাতে কোনো ভাই এর বন্দী হওয়া বা কোনো ভুলের কারণে শাস্তি পাওয়া ও সংগঠনের ক্ষতি হওয়া- সবকিছুই সসীম কিছু পরাজয়। কিন্তু এটাই শেষ না। মাত্রাতিরিক্ত খুশি বা হতাশার কিছু নেই। অসীম মানসিকতার মাহাত্ম্য এখানেই। প্রতিটা দিন একটা নতুন দিন। আগের দিনের ক্লেশ ভুলে আদর্শের উপর টিকে থাকা, নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য এগিয়ে যাওয়া। তানজিমের মূলনীতির উপর অটল থাকতে হবে, নির্দেশনা অনুসরণ করে চলতে হবে সবসময়। এভাবেই সবরের সাথে আমৃত্যু দ্বীন কায়েমের পথে চলতে হবে। এটাই চূড়ান্ত সাফল্য। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমীন।  


খ)  প্রোডাকশন, ভাইদের মধ্যে বিভিন্ন কাজ বন্টন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও আমরা সসীম মানসিকতার পরিচয় প্রদান করি। 


গবেষকগণ বলেন, জীবনের সকল অসীম দ্বন্দ্বে টিকে থাকার জন্য ৫টি বিষয় অত্যাবশ্যক। যথাঃ


১। দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হওয়ার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক লক্ষ্য থাকা।
২। বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল সহযোদ্ধা/টিম। 
৩। সমীহ করার মতো শক্ত প্রতিযোগী। 
৪। আগাম/সম্ভাব্য পরিবর্তনের সাথে দ্রুত মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা এবং সক্ষমতা। 
৫। নিজ কাজের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ততা ও সাহসিকতা।

 


এই ৫ টি পয়েন্টে নজর বুলানোর পর এবার আমরা আমাদের বিদ্যমান কর্মপন্থার দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই- 


ক) আমাদের অনেক মাসুল ভাইদের মধ্যে একধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তা হলো মামুর ভাই এবং নিজেকে সবসময় কাজে ব্যস্ত রাখা। কোনো মামুর ভাই যেন কখনো খালি হাতে বসে না থাকেন এ ব্যাপারে মাসউল ভাইদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে দেখা যায়। কেবল টার্গেট ফিলাপের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে দেখা যায়। 


খ) কাজের ক্ষেত্রে আমরা একটা নির্দিষ্ট  লক্ষ্য নির্ধারণ করি। এরপর সে লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য জান প্রাণ দিয়ে কাজ করি। প্রয়োজনে নিজের এবং মামুর ভাইদের উপর চাপ প্রয়োগ করে, ওভারটাইম করে এবং করিয়ে সেই লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করি। যেন এই টার্গেট পূরণের উপরেই আমাদের সকল কাজ নির্ভর করছে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সে অনুসারে কাজ করাটা মন্দ কিছু নয়। কিন্তু যখন দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর এভাবে অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় লক্ষ্য পূরণের জন্য, তখন বেশ কিছু সমস্যা তৈরি করে, যা আমরা একটু পরেই আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। 


গ) সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে এমন গঠনমূলক কাজের চাইতে মুখরোচক কাজ করতে আমরা অনেকেই বেশী আগ্রহবোধ করি। যেহেতু এতে সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা যায় এবং খুব অল্প সময়ে দ্রুত চোখে পড়ার মতো ফলাফল অর্জন করা যায়। মাঝে মাঝে কিছু মুখরোচক কাজ (যা তানজিমের মূলনীতির আলোকে বাছাইকৃত) করাটা নিন্দনীয় কিছু নয়, এর ফলে ভাইদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। তবে কর্মকেন্দ্রিক পরিকল্পনা মুখরোচক কাজকে কেন্দ্রে রেখে সাজালে বেশ কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। 


আমাদের এই ৩ ধরণের কর্মপন্থাই সসীম মানসিকতার উদাহরণ। এর ফলে জিহাদের অসীম দ্বন্দে টিকে থাকার পথে বহু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-


১।  ভাইয়েরা সবসময় টার্গেট কেন্দ্রিক কাজে ব্যস্ত থাকলে- 


ক) পারিপার্শ্বিক পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হয় না। প্রথম কয়েক বছর ঠিক থাকলেও  টার্গেট পূরণের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে কয়েক বছর পরের জনমানসিকতা, সমাজ, বৈশ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনের অবকাশ মেলে না। এর ফলে পরিবর্তিত বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক থেকে জনমানুষের মনের খোরাক, চিন্তা চেতনা,দাবী,চাহিদা ইত্যাদি বোঝা ও পূরণ করা সম্ভব হয় না। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে অসীম যুদ্ধ থেকে ছিটকে যাবার ঝুঁকি তৈরি হয়। 


খ) ভাইদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ক্রমাগত মানোয়ন্নন করা অসীম যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কিন্তু  দিন রাত শুধু টার্গেট পূরণের জন্য টার্গেট কেন্দ্রিক কাজ করে গেলে ভাইদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় না, ক্রমাগত মানোয়ন্নন অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির এই যুগে প্রতিনিয়ত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। শত্রুপক্ষ নিত্য নতুন প্রযুক্তি, কলাকৌশল ইত্যাদি রপ্ত করে আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করবে। এর ফলে আমাদের পক্ষে অসীম মানসিকতার যুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। 


দুইজন লোক করাত দিয়ে গাছ কাটছিল। কিন্তু করাতটি ছিল ভোঁতা। তাদের বলা হলো, ভাই ! আপনারা করাতটিতে ধার দিয়ে নিন। এরপর গাছ কাটেন। কিন্তু তারা বলল- করাতে ধার দেবার জন্য আমাদের ৩০ মিনিট ব্যয় করতে হবে। এই সময়টুকুতে গাছ কাটলে আমরা কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখতে পারব!


আমাদের অনেকেরই অবস্থা এই দুই লোকের মতো। ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করে করাতে ধার দিলে তা যে গাছ কাটার সময় বা কষ্ট অনেক কমিয়ে দেবে – এই বিষয়টি আমরা বুঝতে চাই না। আমরা বুঝতে চাইনা টার্গেট ভিত্তিক কাজ থেকে কিছু সময় বের করে দক্ষতা বৃদ্ধি বা ফিকরি কাজে ব্যয় করলে তা একদিকে যেমন আমাদের সবসময় পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে, সেই সঙ্গে আমাদের টার্গেটের কাজও বহু গুনে বাড়িয়ে দেবে।  

 

গ) কাজ এগিয়ে নেয়া, কাজ গোছানোর জন্য ব্যবস্থাপনার মূল বিষয় হলো কাজের একটি সিস্টেম বা নিজাম থাকা এবং বাকি সব কাজ এর অনুগামী হওয়া। শুধু টার্গেট ভিত্তিক কাজ করতে এই ক্ষেত্রে দুইটি সমস্যা হয়ঃ

 

(১) সিস্টেম বা নিজাম দাঁড় করানোর পরিবর্তে কেবল সংখ্যা বাড়ানো, টার্গেট বা লক্ষ্যে পৌঁছা ইত্যাদি বিষয়ে নজর দেওয়া হয়। এতে সিস্টেম বা নিজাম কখনোই দাঁড় হয় না, হলেও বিক্ষিপ্ত, অসম্পূর্ণ হয়।

 

(২) কোনো সিস্টেম বা নিজাম ইতোমধ্যে তৈরি করা থাকলে সেই নিজামের সাথে দুইটি বিষয় হয়ঃ

 

i. ক্রমাগত পরিবর্তন ও মানোন্নয়নের যে মূলনীতি এর আলোকে সিস্টেম বা নিজামের মানোন্নয়ন, ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন সম্ভবপর হয় না। ফলে সিস্টেম বা নিজাম সময়ের চাহিদা পূরণ করতে পারে না এবং এর জন্য যোগ্য লোকও গড়ে উঠে না।


ii. যখন লক্ষ্য পূরনে সিস্টেম বা নিজামের কোনো অংশ বাধা হয়ে দাড়ায়, তখন সেই অংশকে বাদ দিয়ে, পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাটাই মূল মাকসাদ হয়ে উঠে। এতে এক সময় কাজের জন্য সিস্টেম বা নিজাম আর মূল বিষয় থাকে না। লক্ষ্য অর্জনই মূল হয়ে যায়। ফলে কাজ নিরাপদ, স্থিতিশীল, টেকসইভাবে গড়ে উঠে না। 
যেমন: আমাদের নিরাপত্তার একটি নিজাম আছে। কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে প্রায়ই নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একারণে অনেককেই দেখা যায় নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে কাজ আঞ্জাম দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ফলে স্বল্প মেয়াদে ভাইদের কাজ বেশ চমকপ্রদ হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে কাজ টেকসই, স্থিতিশীল হয় না। ফলে প্রাথমিকভাবে মারহাবা বলার মতো চমক সহজেই দেখানো যায়। কিন্তু বাস্তবে 'হায়! হায়!'-ই হয়ে থাকে।


তাই টার্গেট কেন্দ্রিক কাজের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন কর্মঘন্টার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দক্ষতা বৃদ্ধি, ক্রমাগত মানোন্নয়নের কাজে ব্যয় করতে হবে। তা হতে পারে জিহাদের কোনো কৌশল শেখা, বই পড়া, টিউটোরিয়াল দেখা বা কোনো দক্ষতা অর্জন করা।


২।  দীর্ঘ সময় ধরে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে টার্গেট পূরণ করার কর্মপদ্ধতি যে সমস্যা তৈরি করে- 


ওভারটাইম কাজ করে প্রথম কয়েক মাস বা কয়েক বছর অনেক কাজ করে ফেলা সম্ভব। আমরা যে বেশী বেশী কাজ করব এই ভেবে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করি তার চাইতেও অনেক বেশী কাজ করা সম্ভব হয়। কিন্তু আমাদের এই জিহাদ কয়েক মাস বা কয়েক বছরের নয়। এই জিহাদ অসীম। আর বছরের পর বছর জুড়ে  গুনগত মান বজায় রেখে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করার উপযোগী করে আমাদের শরীর গঠিত হয়নি। এর ফলে অনেক সমস্যার উদ্ভব হয়। যেমন-  


ক) ভাইদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়বে। কাজের পরিমাণ ও গুনগত মান কমে আসবে।  সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে।


খ) নিজ কাজে স্বতঃস্ফূর্ততা,আন্তরিকতা কমে আসবে।  মনের উপর জোর খাটিয়ে কাজ করতে হবে যা কাজের পরিমাণ ও গুনগত মানকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। পাশাপাশি জিহাদের কাজ আল্লাহর কাছে কবুলিয়াতের আশায় না করে মাসউল ভাই এর বকুনি থেকে বাঁচা, টার্গেট পূরণ ইত্যাদির জন্য করা অর্থাৎ নিয়্যতের মারাত্মক ফিতনাহ তৈরি হতে পারে, যা আমাদের সব কাজ বরবাদ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।   


গ) ভাইদের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো  (দাম্পত্য সম্পর্ক, সন্তান, পিতামাতা,সামাজিক সম্পর্ক) ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সম্পর্কে টানাপোড়েন, ভুল বোঝাবুঝি ইত্যাদি তৈরি হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে জিহাদের কাজে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। 


ঘ) তানজিমের ভাইদের (মাসউল-মামুর) সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মামুর ভাই এর অন্তরে মাসউল ভাইয়ের প্রতি চাপা ক্ষোভ জন্মানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তেমনি মাসউল ভাইদের অন্তরেও মামুর ভাইদের প্রতি বিভিন্ন নেতিবাচক চিন্তা (ফাঁকিবাজ, অলস, দায়িত্বজ্ঞানহীন, আনুগত্য বোধের অভাব ইত্যাদি) জন্মগ্রহণ করতে পারে। যা একটি বিশ্বস্ত টিম গঠণ ও টিম ওয়ার্ক এর মাধ্যমে জিহাদের অসীম দ্বন্দে টিকে থাকার পথে মারাত্মক হুমকি তৈরি করবে। 


ঙ) ওভারটাইম কাজ করার মানসিকতা থেকে অনেক ভাই-ই দুনিয়াবি প্রয়োজন পূরণের জন্য যে অর্থ উপার্জন করা দরকার সেকাজে অবহেলা,উদাসীনতা প্রদর্শন করেন। এর ফলে ভাইয়েরা প্রথম কিছুদিন অনেক বেশী কাজ করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে যখন আর্থিক পরীক্ষার সম্মুখীন হন, তখন একেবারেই জিহাদের কাজ থেকে দূরে সরে যান। 

 

চ) এসবের ফলে রুহানিয়্যাত ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যেহেতু ওই দিকে গভীর মনোযোগ একই সাথে দেওয়া অনেকের জন্য সম্ভব হয় না। এতে আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়। পরীক্ষায় পড়লে ভাইদের ইস্তিকামাত থাকা কঠিন হয়ে যায়। ইবাদতের স্বাদ কমে যায়। অন্তর শক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর পানাহ।


তাই অসীম মানসিকতার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য আমাদের ব্যক্তিগত ও তানজিমের কাজে ভারসাম্য বজায় রাখা (লাইফ ওয়ার্ক ব্যালান্স), নিজের আত্মিক,মানসিক,শারীরিক প্রয়োজন পূরণে যত্নবান হওয়া, সুযোগ থাকলে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সমৃদ্ধি অর্জন করা ইত্যাদি ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করতে হবে।  


৩। শুধু মুখরোচক টপিক কেন্দ্রিক কাজ করলে যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়- 


ক) তানজিমের সাধারণ মূলনীতি সমূহ বিবেচনায় নিলে সব মুখরোচক টপিকে কাজ করা আমাদের জন্য জরুরি নয়। কিন্তু মুখরোচক টপিক কেন্দ্রিক পরিকল্পনা সাজালে মূলনীতিতে কম গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এমন টপিকেও অনেক শ্রমঘন্টা ও সম্পদ ব্যয় করার দরকার পড়ে। এটি সুস্পষ্ট অপচয়। 


খ) শুধু মুখরোচক টপিকে কাজ করার ফলে দীর্ঘমেয়াদে জিহাদের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে পারে এমন গঠণমূলক কাজ করার অবকাশ মেলে না। এরফলে অল্প সময়ে বেশ কিছু সদস্য বা মিডিয়াতে কিছু সাবস্ক্রাইবার পাওয়া গেলেও জনগণকে দীর্ঘমেয়াদী জিহাদের বুঝ প্রদান করা, সমর্থক বানানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে গেলেও জনগনের বুঝের তেমন  একটা উন্নতি হয় না। ইন্টারনেটের লাদেন হিসেবে পরিচিত, মিডিয়া জিহাদের এক বিরল প্রতিভা, কুফফারদের অন্তরে ত্রাস সৃষ্টিকারী শায়খ আনোয়ার আল আওলাকি রহিমাহুল্লাহর অধিকাংশ কাজই ছিল গঠণমূলক যা দীর্ঘমেয়াদী জিহাদের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করে চলেছে।    


গ) সামাজিক যোগাযোগ  মাধ্যমের কল্যাণে মুখরোচক ইস্যুগুলো খুব দ্রুতই পরিবর্তিত হয়। সব মুখরোচক ইস্যুতে কাজ করা ভাইদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং। এর ফলে ভাইদের অতিরিক্ত চাপ নিতে হয়, ভাইদের মধ্যে অস্থিরতা,উদ্বেগ ও মানসিক অবসাদের জন্ম নেয়। যা ভাইদের ব্যক্তিগত ও তানজিমি জীবনকে নেতিবাচকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। 

 

তবে, মাঝেমধ্যে জনগণকে আকৃষ্ট করতে মুখরোচক কোনো কাজ বা পদক্ষেপ নিতে সমস্যা নেই, বরং এটি জিহাদের জন্য সহায়ক যদি না কোনো মৌলিক মূলনীতিকে ব্যাহত করে। 


নিজের ব্যাপারে সৎ হই


আল্লাহ তায়ালা বলেন:

 

وَقُل لِّعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوًّا مُّبِينًا ‎﴿٥٣﴾‏

‘আপনি আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন  সেসব কথাই বলে  যা অতি উত্তম। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত কথা হলো, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’ [ সুরা বানী ইসরাইল : ৫৩]


শয়তান বলল :

 
قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ
ثُمَّ لَآتِيَنَّهُم مِّن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَن شَمَائِلِهِمْ ۖ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ
 

‘তুমি যেমন আমাকে গোমরাহিতে নিক্ষেপ করেছ, তেমনি আমিও এখন তোমার সরল সত্য পথে এ লোকদের জন্য ওঁৎ পেতে থাকব। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনে থেকে, পেছন থেকে, ডান থেকে, বাম থেকে এবং অধিকাংশকে তুমি শোকর গুজার পাবে না।’ [সুরা আল আরাফ, ১৬-১৭]


আমাদের যুদ্ধ অসীম। অসীম মানসিকতা সঙ্গে নিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে চলতে হবে এই পথে। অসীম মানসিকতার এই বুঝকে কেন্দ্র করে শয়তান আমাদের অনেকের মধ্যেই অলসতা, উদাসীনতা ,দুনিয়ার ধন-সম্পদ, স্ত্রী-সন্তান ,সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণের ফিতনায় ফেলে দিতে পারে। এমন ভুল বুঝ আমাদের মাঝে তৈরী করতে পারে "যেহেতু আমাদের যুদ্ধ অসীম, কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কাজেই এই কাজটি আজকে না করে আগামী কাল করি।" আগামীকাল আবার ভাবি তার পরের দিন করি। এভাবে যে কাজ আজকেই হয়ে যেত সেই কাজ বহুদিনেও আর শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না… 


মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য  প্রকৃতির কাছাকাছি সফরে গেলাম। দুই দিন থাকলেই আমার প্রয়োজন পূরণ হয়ে যেত কিন্তু থেকে গেলাম বেশ কয়েকদিন… 
অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য জীবিকার কাজে এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে জিহাদের কাজকেই ভুলে গেল……  
বিশ্বস্ত, সহযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন টিম তৈরির জন্য আমার মাসউল ভাই আমাকে নির্দিষ্ট সময়ে জরুরি একটি কাজ শেষ করার তাড়া দিলেন না। আমি এই সুযোগে ডেডলাইনের পরেও বেশ কিছু দিন অলসতা করে কাটিয়ে দিলাম…  


পরিবর্তিত বাস্তবতায় খাপ খাওয়ানোর জন্য এমন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করলাম, যা ইসলামী শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক… 
যে কোনো প্রকারে টিকে থাকাটাই প্রধান লক্ষ্য এ ভেবে সুযোগ ও সক্ষমতা থাকার পরেও জিহাদের কাজ এগিয়ে নেবার জন্য তানজিমের সাধারণ মূলনীতিসমূহের আলোকে  কোনো স্ট্র্যাটেজি বা কলাকৌশল নির্ধারণ করলাম না…। 


এমন অনেকভাবেই শয়তান আমাদের ফিতনায় ফেলতে পারে। তাই আমাদের সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে। সর্বদা আমাদের  নিয়্যতকে, আমাদের অন্তরকে পরখ করে দেখতে হবে। সৎ পথে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দুয়া করতে হবে। 

 

يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
“হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে আপনার দীনের ওপর স্থির রাখুন।” [তিরমিজি শরিফ-২১৪০]

 

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ ‎﴿٨﴾‏

হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান করুন। আপনিই সব কিছুর দাতা। [সুরা আলে ইমরান, ৮]


উপসংহার: উপরে আমাদের কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সসীম মানসিকতার কিছু বহিঃপ্রকাশ উদাহরণ হিসেবে আলোচিত হয়েছে।
আমরা বিষয়টাকে আত্নস্থ করে নিজের দূর্বলতাগুলো চিহ্নিত করবো, খুঁজে বের করবো আমার নিজের কোথায় কোথায় সসীম মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সেগুলোকে অসীম মানসিকতায় রূপান্তরের চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।


পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখবো - অসীম মানসিকতার নাম দিয়ে আমরা যেন কোনো অলসতা কিংবা অবহেলা না করি। আল্লাহর সাথে সর্বদা সৎ থাকতে হবে।


আল্লাহ আমাদের সবাইকে যা শিখলাম তার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন। 


ওয়াল্লাহু তায়ালা আ'লাম।

0 মন্তব্যসমূহ