ইসলামোফ্যাসিজম

 

                             ইসলামোফ্যাসিজম

শব্দেরও ভাগ্য থাকে। কিছু শব্দ জন্ম নেয় আলো ছড়াতে, আবার কিছু শব্দ তৈরি হয় অন্ধকার ঘন করার জন্য। “ইসলামোফ্যাসিবাদ”—একটি এমন শব্দ, যার উচ্চারণেই তৈরি হয় বিভ্রান্তির ঘূর্ণি। একদিকে ফ্যাসিবাদ, যার স্মৃতি জড়িয়ে আছে লোহার মুষ্ঠি, রক্তের স্রোত আর মানবতার ওপর নেমে আসা অন্ধকারের সাথে। অন্যদিকে ইসলাম, যে নামের ভেতর রয়েছে আধ্যাত্মিকতা, বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার দীপ্তি। 

এই দুটিকে জোর করে একসাথে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যেন আতঙ্কের এক নতুন রূপ দাঁড় করানো যায়। অথচ শব্দটির ভিতরে যতটা দম্ভ আছে, তার ভিত্তি ততটাই দুর্বল—এই শব্দ গবেষণার কোনো ফল নয়, বরং রাজনৈতিক প্রচারণার এক ছদ্মনাম মাত্র। শব্দটি কখনোই নিরপেক্ষ একাডেমিক ধারণা ছিল না; বরং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তৈরি করা একটি হাতিয়ার।

একটি জটিল বাস্তবতাকে সরলীকরণ করার জন্য শব্দটির জন্ম, আর সেই জন্ম থেকেই এতে লুকিয়ে আছে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা। ‘ইসলামোফ্যাসিবাদ’ শব্দটি বিশ শতকের শুরু থেকে নানা পর্যায়ে ব্যবহৃত হলেও ৯/১১ পরবর্তী সময়ে এটি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। তবে শব্দটির আয়ু খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি; আজ এটি গবেষণার অঙ্গনে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে স্মরণীয়। 

কিন্তু আজকের বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, এই শব্দটি নতুন করে রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় প্রবেশ করছে, এর মূল কারণ সম্ভবত—পুরনো ট্যাগগুলো আর আগের মতো কার্যকর নয়। রাজাকার, মানহাজি, জঙ্গি, মৌলবাদী, চরমপন্থি, তাওহিদি জনতা ইত্যাদি ট্যাগগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে; পুরনো ট্যাগগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও জনগণ এখন পূর্বের ট্যাগগুলোকে গুরুত্ব দেয় না। হয়তো সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে নতুন শব্দ ও ট্যাগের আবির্ভাব ঘটেছে, একারণেই “ইসলামোফ্যাসিবাদ” নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে।

মধ্যযুগে ইউরোপের সাধারণ মানুষ চার্চের প্রভাবশালী কাফের পোপদের নির্যাতনের কারণে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছিল। এই নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে তারা নতুন চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক তত্ত্বের সন্ধান শুরু করে। নিজের জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তারা বেশ কিছু নতুন ইজম আবিষ্কার করে এবং তারা সেগুলোকে ব্যবহার করে চার্চের প্রভাবশালী কাফের পোপদের নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভে সফল হয়। 

এই নতুন তত্ত্বের মধ্যে অন্যতম ছিল সেকুলারিজম, লিবারেলিজম, কমিউনিজম ইত্যাদি। তবে এই নতুন চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক তত্ত্বগুলোই পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির জন্ম দেয়, যার মধ্যে ফ্যাসিবাদ অন্যতম, যা জাতির কর্তৃত্বকে সর্বোচ্চ স্থান দেয় এবং চরম জাতীয়তাবাদ, সামরিকতাবাদ ও স্বৈরশাসনের ধারণাকে প্রচার করে। 

অর্থাৎ, মধ্যযুগে ইউরোপের প্রভাবশালী কাফের পোপদের দমন এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আবিষ্কৃত ইজমগুলোই পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন গড়ে তোলার জন্য একটি পটভূমি তৈরি করেছিল, একটি সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল—এর সঙ্গে ইসলামের দূরবর্তী কোনো সম্পর্ক নেই, না উৎপত্তিগত দিক থেকে, না বিস্তৃতির দিক থেকে—কিন্তু তারপরও ইসলামোফ্যাসিবাদ শব্দের বিস্তৃতি ঘটেছে, ঘটানো হয়েছে।

মূলত ‘ইসলামিক ফ্যাসিবাদ’ বা নব্বইয়ের দশক থেকে পরিচিত ‘ইসলামোফ্যাসিবাদ’ শব্দটি “নির্দিষ্ট কিছু ইসলামী আন্দোলন” এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও তার সময়কার ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি তুলনা টানে। কিন্তু এই তুলনা টানা কতটা যৌক্তিক সেটা তারা ভেবে দেখে না, কেননা এখানে যৌক্তিকতা মুখ্য নয়, কাঙ্খিত উদ্দেশ্য হাসিল করাই মুখ্য এবং সেই কাঙ্খিত উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত সকল কিছুকে দমন করা।

১৯৩৩ সালে কবি মুহাম্মদ ইকবাল একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছিলেন তখন আক্তার হুসেন রা'এপুরী (ভারতীয় প্রগতিশীল) কবি মুহাম্মদ ইকবালের এই কার্যক্রমকে “ইসলামিক ফ্যাসিবাদ” বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে সুইস প্রোটেস্ট্যান্ট বুদ্ধিজীবী কার্ল বার্থ ফ্যাসিবাদ এবং ইসলামের মধ্যে একটি ধারণাগত যোগসূত্র টেনে নাৎসিজমকে 'একটি নতুন ইসলাম' বলে সম্বোধন করেছিলেন।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও এই ধরনের তুলনা অব্যাহত ছিল। ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেন মিশরীয় নেতা গামাল আবদেল নাসেরকে 'হিটলার' বা 'মুসলিম মুসোলিনি' বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৬০ এর দশকে, আরবের সংবাদপত্রগুলো মাঝে মাঝে আরবি শব্দ ‘আল-ফাশিয়্যা আল-ইসলামিয়্যা’ (‘ইসলামিক ফ্যাসিবাদ’) ব্যবহার করত, মূলত তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করায় ছিলো উদ্দেশ্য। একই সময়ে, সুদানের রিপাবলিকান ব্রাদার মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদ মোহাম্মদ তাহা ১৯৬৮ সালে আল তুরাবিকে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং ‘মুসোলিনির ছাত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

৯/১১ হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা তথাকথিত "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" এর একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে। সেসময় এই জটিল এবং বহুমুখী হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সহজবোধ্য এবং ঐক্যবদ্ধকারী শব্দ প্রয়োজন ছিল। 'ইসলামোফ্যাসিবাদ' এই শূন্যস্থানটি পূরণ করে। এটি একটি নতুন, শক্তিশালী বর্ণনা তৈরি করে, যা তাদের (আমেরিকা ও তাদের মিত্রদের) বৈশ্বিক সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ন্যায্যতা প্রমাণে সাহায্য করে। 

এই শব্দটির মাধ্যমে পোস্ট ৯/১১ এর হুমকিকে বিশ শতকের নাৎসিজম এবং কমিউনিজমের মতো সর্বজনীনভাবে নিন্দিত মতাদর্শগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের তথাকথিত 'প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ' এর ন্যায্যতা প্রমাণ করতে এবং জনসমর্থন বাড়াতে সাহায্য করে । তখন এই শব্দের বুদ্ধিবৃত্তিক ত্রুটিগুলো এর রাজনৈতিক উপযোগিতার কাছে গৌণ হয়ে যায়।

৯/১১ হামলার পরপরই স্টিফেন শোয়ার্টজ, ক্রিস্টোফার হিচেন্স এবং নরম্যান পডহোরেটজের মতো প্রভাবশালী নব্য রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীরা আল কায়েদাকে বর্ণনা করতে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ডেভিড হোরোভিটজের মতো অ্যাক্টিভিস্টরা 'ইসলামোফ্যাসিবাদ সচেতনতা সপ্তাহ' চালু করে শব্দটি একাডেমিক বৃত্তের বাইরেও ছড়িয়ে দেয়। 

এসকল প্রভাবশালী নব্য রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে প্রচারিত এই শব্দটি দ্রুতই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে। তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০৫-২০০৬ সালে তার এক ভাষণে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সেসময় তিনি 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' কে 'এক নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদ' এর বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

অতপর, আমেরিকার নীতিনির্ধারকরা তাদের রাজনৈতিক ভাষণের কার্যকারিতা নিয়ে কৌশলগত পুনর্মূল্যায়ন শেষে এই উপসংহারে এসেছিলো যে, শব্দটির রাজনৈতিক উপযোগিতা এর কূটনৈতিক ঝুঁকির তুলনায় কম ছিল। সেজন্য ২০০৮ সালের এপ্রিলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্টারটেররিজম সেন্টার বুশ প্রশাসনের অধীনে একটি নির্দেশনা জারি করে, যা স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মতো সংস্থাগুলোকে এই শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।

অর্থাৎ, ইসলামোফ্যাসিবাদ শব্দটির উৎপত্তি একটি একক, পরিষ্কার ঘটনা ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে এই শব্দটির উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দাবি করেছেন। এই একাধিক দাবিগুলো থেকে বোঝা যায় যে শব্দটি কোনো একক লেখকের উদ্ভাবন নয়, বরং এটি একটি ধারণা যা কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে পর্যায়ক্রমে উদ্ভূত হয়েছে। তবে এই শব্দটির প্রয়োগের বিবর্তনে একটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। 

প্রাথমিক তুলনাগুলো প্রায়শই সামগ্রিক ইসলামকে 'ফ্যাসিবাদ' এর সাথে যুক্ত করত, যেমন কার্ল বার্থের 'একটি নতুন ইসলাম'। কিন্তু ৯/১১ এর পর এর ব্যবহার একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ এর সঙ্গে ফ্যাসিবাদকে যুক্ত করার চেষ্টা করে। এই পরিবর্তনটি কেবল ভাষাগত ছিল না, এটি শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহারের কৌশলগত পরিবর্তনকেও প্রতিফলিত করে। এটি সামগ্রিক ইসলামকে আক্রমণ করার পরিবর্তে “একটি নির্দিষ্ট” রাজনৈতিক আন্দোলনকে আক্রমণ করার একটি আপাতদৃষ্টিতে আরও নির্ভুল উপায় খুঁজে বের করে।

এখানে মজার বিষয় হচ্ছে, সেই “নির্দিষ্ট” রাজনৈতিক আন্দোলনকে নির্দিষ্টকরণ করেছে স্বয়ং পশ্চিমারাই—এর সঙ্গেও ইসলামের দূরবর্তী কোনো সম্পর্ক নেই। সেই “নির্দিষ্ট” রাজনৈতিক আন্দোলনকে পশ্চিমারা ইসলামবাদ বা ইসলামিজম বলে নামকরণ করেছে। 'ইসলামিজম' শব্দটির উৎপত্তি মুসলিম বিশ্বে হয়নি, বরং সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফরাসি লেখকদের মাধ্যমে এর প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। Le Petit Robert অভিধান অনুযায়ী, শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয় ১৬৯৭ সালে। 

 ইনলাইটমেন্ট যুগের দার্শনিক ভলতেয়ার এই শব্দটির প্রচার-প্রসারে বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। বিকৃত খ্রিষ্টধর্ম এবং তার প্রতিনিধিত্বকারী চার্চের কাফের পোপদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে ইউরোপের মানুষজন ধর্মের (বিকৃত খ্রিষ্টধর্মের) বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছিলো। সেইজন্য তখন তারা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলো এবং ঐ প্রেক্ষাপটে দাড়িয়েই, তারা ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলামকে বোঝার জন্য ‘ইসলামিজম’ শব্দটি আবিষ্কার করেছিল। 

অর্থাৎ, ‘ইসলামিজম’ শব্দটি পশ্চিমা শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রবর্তিত এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে তাদের (পশ্চিমাদের) নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ ও শ্রেণিবদ্ধ করা।

অর্থাৎ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামোফ্যাসিবাদ শব্দটা যেই দুইটা শব্দের সংমিশ্রণে তৈরি ( ইসলামবাদ/ইসলামিজম + ফ্যাসিবাদ/ফ্যাসিজম), সেই দুইটা শব্দ পশ্চিমা দৃষ্টিকোণের ছাঁচে তৈরি, এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।               

0 মন্তব্যসমূহ