পর্ব-৮ অসীম মানসিকতার কষ্টিপাথর ১ (খ): "লড়াইয়ে উত্থান-পতন থাকবেই, সবসময় কাজ এক গতিতে থাকবেনা"

 

অসীম মানসিকতার কষ্টিপাথর ১ (খ):

"লড়াইয়ে উত্থান-পতন থাকবেই, সবসময় কাজ এক গতিতে থাকবেনা"


===========================================================

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم

  إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه .  أمابعد

 

 

মাকসাদ:  আল্লাহ তায়ালা বলেন -

وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ

"এই দিনগুলো আমি মানুষের মাঝে পালাক্রমে আবর্তন করি "। [সুরা আলে ইমরান ৩:১৪০]

 

কুরআনে বর্ণিত এই সুন্নাতুল্লাহ বোঝার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, সুন্নাতুল্লাহ না বুঝে কখনোই অসীম দ্বন্দ্বে টিকে থাকা সম্ভব না। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অবাস্তব-কাল্পনিক-অতিআবেগী ধারণা নিয়ে কখনোই অসীম যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব না।

 

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ব্যক্তিজীবনে ও উম্মাহর পথচলায় উত্থান এবং পতন দুটোই থাকবে, এটাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এটা অসীম মানসিকতার কষ্টিপাথরও বটে।
অর্থাৎ আমি অসীম মানসিকতার অধিকারী কিনা এটা পরখ করার একটি মাধ্যম হলো কুরআনে বর্ণিত এই সুন্নাতুল্লাহর সঠিক বুঝ আমার মাঝে আছে কি না। এ বিষয়গুলো বোঝাই এ সবকের মাকসাদ।

 

 

 

শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এই বুঝ রাখা যে, আমাদের এই সফরে ক্রমাগত উত্থান-পতন থাকবে।


লড়াই এ উত্থান পতন থাকবে, পথ কখনো সুষম হবে না। আমরা সব সময় একই গতিতে কাজ চালিয়ে যেতে পারব না। কখনো আমাদের ভাল সময় যাবে, কখনো  খারাপ সময় যাবে,  কখনো আবার মধ্যম পর্যায়ের সময় যাবে। এসব মেনে নিয়েই  লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। 


আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও সব দিন একই রকম যায় না।ঈমানের অবস্থা কখনো খুবই ভালো থাকে, কখনো খুবই নাজুক হয়ে পড়ে, কখনো আমাদের জন্য দুনিয়া সংকুচিত হয়ে পড়ে,কখনো জমীন প্রশস্ত হয়ে যায়,কখনো জীবন স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যায়। 


দলীয় ক্ষেত্রেও বিষয়গুলো এমন। আমরা সবসময় কুফফারদের হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হবো বা আমরা সবসময় তাদেরকে আঘাত দেব বিষয়টি এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মাঝে দিনগুলো পালাক্রমে আবর্তিত হয়।

আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন: 


اِنۡ یَّمۡسَسۡکُمۡ قَرۡحٌ فَقَدۡ مَسَّ الۡقَوۡمَ قَرۡحٌ مِّثۡلُهٗ ؕ وَ تِلۡکَ الۡاَیَّامُ نُدَاوِلُهَا بَیۡنَ النَّاسِ ۚ

“যদি তোমাদেরকে কোন আঘাত স্পর্শ করে থাকে তবে তার অনুরূপ আঘাত উক্ত কওমকেও স্পর্শ করেছে। আর এইসব দিন আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন করি”। [সুরা আলে-ইমরান ৩:১৪০]


কখনো কুফফাররা আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে আবার কখনো আমরা তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করব। স্বাভাবিকভাবে কুফফাররা মুমিনদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়ে থাকে। শায়খ আব্দুল কাদির বিন আব্দুল আজিজ (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর "আল উমদাহ ফি ই'দাদিল উদ্দাহ"  কিতাবে খুব সুন্দরভাবে এ বিষয়টি আলোচনা করেছেন। শক্তির এ তারতম্যের  মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের পরীক্ষা করবেন। আমরা দুর্বল অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল রেখে এগিয়ে যাই কিনা তা যাচাই করবেন। এটিই তো আসলে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। 


কুফফাররা যদি শক্তিশালী না হয় তারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সাহসই করতে পারবে না। মূলত এই কারণে তাকদিরের নিয়মেই কুফফাররা আমাদের  চাইতে অধিক শক্তিশালী হয়ে থাকে। এটি আল্লাহর চিরায়ত নিয়মের একটি অংশ যেন তিনি আমাদেরকে পরখ করে দেখতে পারেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 


وَ لِیَعۡلَمَ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ یَتَّخِذَ مِنۡکُمۡ شُهَدَآءَ ؕ 

“এবং যাতে আল্লাহ ঈমানদারদেরকে জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে শহীদদেরকে গ্রহণ করেন”। [সূরা: আলে-ইমরান,৩:১৪০]


আমরা অতি সাধারণ মানুষ। আমাদের জন্য শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করা আল্লাহ তায়ালার এক বিশাল নিয়ামত। কিন্তু তিনি আমাদের মধ্য থেকে কেবল তাঁর পছন্দের কিছু মানুষকেই শাহাদাতের মর্যাদা  দান করবেন এই দিনগুলো পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে। 


তাহলে আমরা পেলাম- 
ক)  ব্যক্তিগত বা তানজিমী জীবনে উত্থান পতন থাকবেই।
খ)  দুনিয়ার জীবন জান্নাত নয়। সবসময় আমাদের সুসময় চলবে না।
গ) আল্লাহ তায়ালার সুন্নাহ এই যে, এভাবে তিনি আমাদের পরীক্ষা করবেন। 


আমরা পছন্দ করি বা না করি ব্যর্থতা জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সব কাজ সব সময় খুব ভালোভাবে করতে পারব না। কখনো আমাদের একটা কাজ খুব ভালোভাবে যাবে, কখনো আমাদের  কাজ মন্দ যাবে এবং কখনো আমরা ভুল করব। এটি জীবনের অলঙ্ঘনীয় এক বাস্তবতা। কিন্তু আমরা এ বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়ি। 


যেমন- একজন দ্বায়ী ভাই মনঃকষ্টে ভুগছেন। কারণ, অনেক চেষ্টার পরেও মাদউর ব্যাপারে তিনি  সফলতা পাচ্ছেন না। একজন মিডিয়ার ভাই কষ্ট পাচ্ছেন, কেন  আমাদের বেশি বেশি ভিউ হচ্ছে না। কেন একজন মামুর ভাই অন্যরকম আচরণ করছে- তা ভেবে একজন মাসুল ভাই নিজের উপর হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। চিন্তা করছেন- এখন আমি কী করব? 


কী করব এই প্রশ্নের আগে এটি প্রথমে বুঝতে হবে যে  সাময়িক ব্যর্থতা আমাদের এই সফরের একটা অংশ। এটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না, এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এটাকে গ্রহন করুন। সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো  উক্ত সমস্যা মেনে নেওয়া। এটাই বাস্তবতা, হা-হুতাশ করার কোন বিষয় না, এটা হবেই। এখানে ব্যর্থতা আসবে, এখানে মন্দ সময় যাবে। প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রেই এটা এই সফরের অংশ । 
 

জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে- আমরা সব কিছুতে জয়লাভ করতে পারব না। হয়ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা পরাজয়ের সম্মুখীন হব। জীবনের এই বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিতে পারি না।  এটা এক মারাত্মক সমস্যা। যা তৈরি হবার অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের বেড়ে উঠার পরিবেশ।


আমাদের বাবা-মা,আত্মীয়স্বজন,প্রতিবেশী,শুভানুধ্যায়ী,গুরুজন আমাদের অনেক ভালোবাসেন, মঙ্গল কামনা করেন । অথচ তারাই আমাদের মাঝে এই নেতিবাচক মানসিকতার বীজ বপন করে দেন। তারা আমাদের শেখান- আমরা অসম্ভব প্রতিভাধর, আমরা চাইলে যেকোনো কিছু হতে পারব। চাইলেই যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারব।  সব বিষয়ে পারদর্শী (All rounder), সব্যসাচী মানুষ হতে পারব ! মানব ইতিহাসের যতো বড় বড় মনীষী, পন্ডিত এসেছিলেন চাইলে তাদেরও ছাড়িয়ে যেতে পারব! 


আমাদের প্রতি ভালোবাসার স্থান থেকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অদ্ভুত এক কাল্পনিক ধারণা তাঁরা আমাদের মাঝে তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু এটি আমাদের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সবাই মনে করছে যে কোনো এক ব্যক্তির  পরাজয়ের মূল কারণ হলো তার অনুপ্রেরণার অভাব। শুরুতেই সে ধরে নেয়- 'আমি এটা করতে পারব না'। অথচ প্রকৃত বিষয় হলো আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিজেদের অতিমূল্যায়ন করা। এরপর আমরা অতি অল্প সময় হাতে রেখে এমন কিছু করতে চাই যা একজন সফল মানুষের দশ পনের বছর অর্জন। বা একজন প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ দশ পনের বছরেও তা অর্জন করতে পারে না। আমরা মনে করি যে আমরা তা খুব সহজেই করে ফেলব। এভাবে অদ্ভুত এক চিন্তা নিয়ে আমরা বড় হই। এরপর জীবনের বাস্তবতা যখন  সামনে আসে, যখন জীবনে ধাক্কা খাওয়া শুরু করি তখন আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ব্যর্থতা মেনে নিতে পারিনা। দিশেহারা হয়ে পড়ি। যদি দুনিয়াবি কাজে এমন ব্যর্থতার সম্মুখীন হই তখন দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে, সবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দ্বীনের পথে চলে আসি। আবার যখন দ্বীনের পথে বাঁধা আসে,ব্যর্থতা আসে তখন দ্বীনের সবকিছু ছেড়ে দুনিয়ার পথে চলে যাই। ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না। 

 

আর এই ধাক্কা খাওয়ার পরে সাধারণত মানুষের মাঝে ওই সমস্যার বীজও বপন হয়, তার অনুপ্রেরণার অভাব শুরু হয়। সে কোনো কাজ শুরুর আগেই ধরে নেয়, আমার দ্বারা কোনো কাজ হবে না। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অথচ যদি সে প্রথম থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে চলতো, বাস্তবতা বুঝে ও মেনে নিয়ে এগুতো, তাহলে তার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, অনুপ্রেরণার অভাব হতো না, ইনশাআল্লাহ।


জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারসাম্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে ভারসাম্য হচ্ছে- দ্বীন এবং দুনিয়াবি সকল কাজে উত্থান পতন থাকবে-এটা মেনে নেওয়া।  এটিই আল্লাহর এক চিরন্তন সুন্নাহ। পৃথিবীর সকল মানুষকেই এর মুখোমুখি হতে হয়। তাবৎ শক্তিশালী রাজা, বাদশা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্বৈরশাসক… কেউই এ থেকে পরিত্রাণ পায় না।  


উপসংহারঃ আমাদের জীবনে শুধু পরাজয়ই থাকবে, কখনো বিজয় আসবেনা - এমন মানসিকতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কারণ, এই মানসিকতা  হতাশা ও হীনমন্যতার জন্ম দিয়ে আমাদেরকে অসীম দ্বন্দে প্রবেশই করতে দেয়না।


আবার আমাদের জীবনে কেবল বিজয়ই থাকবে, পরাজয় কখনোই আসবেনা - এমন বাস্তবতাবিবর্জিত ধারণাও রাখা যাবেনা। কারণ, এতে করে পরাজয় আসামাত্র কল্পনার প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়বে এবং আমরা অসীম দ্বন্দ থেকে ছিটকে পড়বো। বরং ভারসাম্যপূর্ণ বুঝ রাখতে হবে। 


ওয়াল্লাহু তায়ালা আ'লাম।

0 মন্তব্যসমূহ