পর্ব-০৭ অসীম মানসিকতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ : বিশদ ব্যাখ্যা ও আরো কিছু উদাহরণ

 

অসীম মানসিকতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ :

বিশদ ব্যাখ্যা ও আরো কিছু উদাহরণ


===================================================

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيم

  إِنَّ الْحَمْدَ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوْذُ بِاللّٰهِ مِنْ شُرُوْرِ أنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللّٰهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَنَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ، وَنَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُه .  أمابعد

 

 

মাকসাদ: ইনফিনিট গেইমের যেসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ আমরা পূর্বের সবকে পড়েছি সেগুলো আরো কিছু জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে সহজ ও প্রায়োগিক পদ্ধতিতে বুঝা নেওয়া আমাদের এই সবকের মাকসাদ।

 

আগের আলোচনায় আমরা পড়েছি - 


১। ইনফিনিট গেইমে জয় পরাজয় মূল বিষয় না। মূল বিষয় হলো কাজটা চালিয়ে যাওয়া। 
২। ইনফিনিট গেইমকে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতির মাঝে আবদ্ধ করা যায় না। 
৩। ইনফিনিট গেইমে শত্রু কখনো নির্মূল হয়ে যায় না। এক প্রতিপক্ষ পরাজিত হলেও অন্য প্রতিপক্ষ আসে।
৪। ইনফিনিট গেইম বা অসীম দ্বন্দে একই সময়ে একাধিক শত্রুর সাথে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হতে পারে। কিন্তু ফাইনাইট গেইমে প্রতিপক্ষ সুনির্দিষ্ট থাকে।

 

সেখান থেকে ১ ও ২ নম্বর পয়েন্টটি আরেকটু ব্যাখ্যা করে আমরা আলোচনার পরের অংশে প্রবেশ করব ইনশাআল্লাহ।  
 

আমরা আবারও স্নাতকের উদাহরণে ফেরত যাই। স্নাতক করার সময় আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় অধ্যয়ন করতে হয়। তাহলেই আমাদের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন বা "যুদ্ধে বিজয়" অর্জিত হয়। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের অসীম ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বলে কিছু নেই।  ধরুন আপনি মনস্থির করলেন- আমি তানজিমের কাজের জন্যে অধ্যয়ন করব। এখন আমার কি কি পড়া উচিত? 


দেখুন, এক্ষেত্রে  আসলে একটি বিষয় পড়ে আপনি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন না।  শুধু ম্যানেজমেন্ট পড়লেই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জিত হয়ে যাবে ব্যাপারটি এমন নয়। ম্যানেজমেন্ট বোঝার জন্য আপনাকে মনোবিজ্ঞান বুঝতে হবে, আপনাকে দর্শন বুঝতে হবে, ক্রিটিক্যাল থিংকিং বুঝতে হবে, আদব শিখতে হবে, শরয়ী ইলম শিখতে হবে। এখানে আসলে সুনির্দিষ্ট বলে কিছু নেই।আপনাকে চতুর্মুখী অধ্যয়ন করে যেতে হবে। 


পড়াশোনার উদাহরণ নিয়ে দীর্ঘ  আলোচনা হলো।  আলহামদুলিল্লাহ।

 

এখন দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। 


চিন্তা করুন, আপনার মায়ের সঙ্গে বা জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে বা আপনার বন্ধুর সঙ্গে বা আপনার কোনো দ্বীনি ভাইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা। এ সম্পর্কের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে জয়পরাজয় বলতে কিছু নেই । চাওয়া পাওয়া বা লেনদেনের ভিত্তিতে এ সম্পর্কগুলো গঠিত হয় না।


আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের এই পর্যায়ে এসে কম বেশী অনেক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। জীবনের প্রথম  পর্যায়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি প্রবণতা ছিল – আমরা পরিবারের উপরেও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে প্রাধান্য দিতাম। বন্ধুত্বের সম্পর্কের চেয়ে কিছুই দামী ছিল না আমাদের কাছে। আমরা অনেক বন্ধু পেয়েছি যাদের অনেকের সঙ্গে এখনো আমাদের বন্ধুত্ব টিকে আছে। তাদের সঙ্গে হয়তো আমাদের আদর্শগত মিল নেই কিন্তু  বন্ধুত্ব থেকে গেছে। এখনো আমরা ওদের অনুভব করি, ওরাও আমাদের অনুভব করে। আদর্শিকভাবে একমত না হবার  পরেও ওরা খোঁজ খবর নেয় (অসীম মানসিকতা)।


কিন্তু আবার আমরা প্রচুর এমনও বন্ধু পেয়েছি যারা কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থের কারণে বন্ধু হয়েছিল। অর্থ, খ্যাতি, দামী খাবার, বিশেষ স্বার্থ উদ্ধার ইত্যাদি নানা কারণে বন্ধুত্ব করেছিল। যখনই তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছে বা তাদের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে, তখন তাদের সাথে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে, তারা দূরে সরে গিয়েছে। বন্ধুত্বের যে মূল মাকসাদ সেটি  অর্জিত হয়নি (সসীম মানসিকতা)


দাম্পত্য জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। আমার স্ত্রী আমার অধীনস্থ। আমি রাজা, আর সে প্রজা। মানসিকতা এমন হলে দাম্পত্য সম্পর্কের মূল মাকসাদ অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। এমন সম্পর্ক টিকে থাকাও কঠিন। (সসীম মানসিকতা)।


তবে আমরা যদি মনে করি এই সম্পর্ক জান্নাতে যাবার সহায়ক।  তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অসীম। এটি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। ইনফিনিট গেইমের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য উত্থান-পতন। কাজেই এই সম্পর্কেও  উত্থান-পতন থাকবে। সম্পর্কের উষ্ণতা, টানাপোড়েন সবকিছুকে মেনে নিয়েই সামনে এগিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। তাহলে ইনশাআল্লাহ দাম্পত্য সম্পর্কের মূল মাকসাদ অর্জিত হবে। (অসীম মানসিকতা )


বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে, দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে আমাদের সম্পর্ক সব সময় সমান যাবে না। উত্থান পতন থাকবে। মান-অভিমান থাকবে । কিন্তু এসব সঙ্গে করে নিয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবে সম্পর্ক শুধু টিকিয়ে রাখতে চাইলেই হবে না। অনেক  মানুষ আছে যারা  মুখে দাবী করে – আমরা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাই।  কিন্তু নিজেদের ভুল সংশোধন করতে চায় না। কেউ কেউ নিজেদের ভুল স্বীকার পর্যন্ত করতে চান না।  হ্যাঁ তারা এটা স্বীকার করবে যে- আমরাও আদম সন্তান, আমাদের ভুল হতেই পারে। কিন্তু কেউ তাদের ভুল ধরিয়ে দিলে তারা সেটা স্বীকার করতে চায় না। মানতে চায় না ওই কাজটি তাদের ভুল হয়েছে। আমাদের এই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ, ইনফিনিট গেইমের মৌলিক একটি উপাদান হলো - ক্রমাগত মানোন্নয়ন। আমরা যদি ভুল স্বীকার, এবং ভুল সংশোধন না করি তাহলে কখনোই মানোন্নয়ন সম্ভব না।

 

দাম্পত্য সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি সম্পর্কের ব্যাপারে যদি আমরা আসলেই আন্তরিক হই এবং আমরা যদি চাই, আমাদের সম্পর্কগুলো আমৃত্যু চালিয়ে নিয়ে যাব, শুধু তাই নয়, আমরা জান্নাতেও একসঙ্গে থাকব; তাহলে সম্পর্কের উত্থান-পতন, ভুল ত্রুটি সব স্বীকার করে নিয়ে সম্পর্কের মানোন্নয়ন চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের ভুলত্রুটিগুলো খুঁজে বের করে সংশোধন করতে হবে। এছাড়া আমরা অগ্রিম কিছু পদক্ষেপ নেব, যেন  ভুলত্রুটি না হয়। ভুলত্রুটি হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখা দিলেই আমরা তড়িৎ পদক্ষেপ নেব, যেন আমরা সম্পর্ক আমৃত্যু চালিয়ে নিতে পারি। আশা করি সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইনফিনিট মাইন্ডসেট বা অসীম মানসিকতা কেমন হয়, তা আমরা বুঝতে পেরেছি।

 

দাম্পত্য সম্পর্ক, পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব এসব সম্পর্কগুলো আসলে একটি অসীম সফরের মতো। ৫ বছর মেয়াদী, ১০ বছর মেয়াদী এমন নির্দিষ্ট কোনো সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। এগুলো জীবনের  কোনো নির্দিষ্ট ইভেন্ট বা ঘটনা নয়। করোনা, বিশ্বযুদ্ধ এগুলো এক একটি ঘটনা ছিল। আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধ ২০ বছর ব্যাপী সংঘটিত হলো। এগুলো সসীম। নির্দিষ্ট সময় পর শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের দ্বীন কায়েমের এই সফরের শেষ নেই। উপরে বর্ণিত উাহরণগুলোর মতো এটা অসীম মানসিকতার একটি ক্ষেত্র।

 

উপসংহার: সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইনফিনিট মাইন্ডসেট বা অসীম মানসিকতা কেমন হয়, সেটি আশা করি আমরা উপরের আলোচনা থেকে সহজেই বুঝতে পেরেছি। আমাদের জীবনযুদ্ধে, আদর্শিক,সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যুদ্ধে ইনফিনিট মাইন্ডসেটের যে ক্ষেত্রগুলো আছে সেগুলোকেও এই আলোচনার সাথে মিলিয়ে প্রায়োগিকভাবে বুঝে নিতে হবে এবং বাস্তব আমলে পরিণত করতে হবে।


আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাওফিক দান করুন। আমীন।


ওয়াল্লাহু তায়ালা আ'লাম।

0 মন্তব্যসমূহ